শ্রীলঙ্কার নায়করা খলনায়ক হলেন যেভাবে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ 

তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সিংহলি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের কাছে নায়ক বনে গিয়েছিল রাজাপাকসে ভ্রাতৃগণ। সেময় প্রেসিডেন্টের আসনে ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। আর তার পাশে প্রতিরক্ষা সচিব হয়েছিলেন ছোট ভাই গোতাবায়া। সেই সূত্র ধরেই দশ বছর পর ক্ষমতায় বসেছিলেন মাহিন্দার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে।

তবে মাহিন্দার পতন হয়েছিল হঠাৎ করেই, তারপর ক্ষমতার বাইরে থাকা মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী করে ২০১৯ সালে আবার মূলধারায় ফেরান গোতাবায়া। যদিও তার বিরুদ্ধে ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ।

নায়কদের খলনায়ক হওয়ার গল্পটা বুঝতে প্রথমেই যেতে হবে সদ্য ক্ষমতা ছেড়ে নৌঘাঁটিতে আত্মগোপন করা মাহিন্দার কাছে। শ্রীলঙ্কার তিন দশকের গৃহযুদ্ধের নির্মম ইতি টেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের কাছে একসময় নায়ক বনে গিয়েছিলেন মাহিন্দা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে তিনি কঠোর হাতে তামিল বিদ্রোহ দমন করেন। বিজয় কুচকাওয়াজে বুক চওড়া করে হাত নাড়া মাহিন্দাকে সিংহল বৌদ্ধ রাজার সাথেও তুলনা করা হয় সেসময়।

লঙ্কান প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুসাল পেরেরা বলেন, শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহল বৌদ্ধ নেতা। এমনকি কেউ কেউ তাকে প্রশংসা করে সম্রাট মাহিন্দা বলেও ডাকত।

পেরেরা ২০১৭ সালে ‘রাজাপাকসে: দ্য সিংহালা সেলফি’-বইতে দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের ভূমিকা এবং কীভাবে মাহিন্দা ক্ষমতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন, সে বিষয়ে আলোচনা করেন। মাহিন্দার বাবা ছিলেন আইনপ্রণেতা। তিনিও ধীরে ধীরে সংসদের বিরোধী দলের নেতা থেকে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন।

এক বছর পর মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট হয়েই তার ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে নীরবে দিন পার করছিলেন গোতাবায়া।

পরে ভাইয়ের প্রচারণায় যোগ দেন গোতাবায়া। দিনে দিনে তিনিও শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। বিপরীতে বেপরোয়া আচরণের জন্য তার সমালোচনাও চলতে থাকে ঢের। এরপরই মাহিন্দার অন্য ভাই ও আত্মীয়রা সরকারে যোগ দেন। মাহিন্দা ছিলেন সবার মাথার ওপর। তার হাতে পুরোদমে চলতে থাকে রাজাপাকসে সাম্রাজ্যের পত্তন।

এত দিন মিলেমিশে থাকলেও সম্প্রতি সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। গোতাবায়া জনদাবি মেনে নিজের গদি বাঁচাতে মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলাতেই সংঘাতের শুরু। যাকে নিজে রাজনীতিতে এনেছেন, সেই ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে হয়তো তিনি এমনটা প্রত্যাশা করেননি। পদত্যাগের কয়েকদিন আগেও তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় না প্রেসিডেন্ট (গোতাবায়া) আমাকে পদত্যাগ করতে বলবেন।’

পেরেরা এ বিষয়ে বলেন, ‘মূলত তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। তরুণদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তিনি সরতে বাধ্য হয়েছেন। বয়সের কারণে তিনি আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন না।’

রাজাপাকসে ভাইদের মধ্যে কোনো ধরনের টানাপোড়েনের কথা অস্বীকার করলেও মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল চলতি সপ্তাহে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ‘নিশ্চিতভাবে প্রেসিডেন্ট এবং (সাবেক) প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নীতিগত মতপার্থক্য রয়েছে।’

নামাল বলেন, তাঁর বাবা সব সময় কৃষক ও গণমানুষের সঙ্গে ছিলেন। অন্যদিকে গোতাবায়া রাজাপাকসের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন, তিনি ‘গণমানুষ অথবা ক্ষমতাসীন এসএলপিপি মূল ভোট ব্যাংকের চেয়ে ভাসমান ভোটে বেশি নজর দেন।’

মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার মধ্য দিয়েই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের যবনিকাপাত হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। এবার ২০১৯ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া গোতাবায়ার এই খলনায়ক অধ্যায় শেষ হবে কীভাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও বিবিসি বলছে, বর্তমানে ক্ষমতা না ছাড়তে চাইলেও দ্বিতীয়বার নাকি আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে চাইছেন না গোতাবায়া।

বিপরীতে অর্থ সঙ্কটের কারণে নানা ধরণের সঙ্কটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কানরা গোতাবায়াকে আর এক মুহূর্তও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাইছে না।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন