শূন্য থেকে সফল রাজশাহীর সাদ্দাম

আব্দুল্লাহ আল মারুফ
ভাই এদিকে আসুন, ভালো লিচু আছে। কতগুলো দিবো বলেন? সরকারী চাকরিজীবী বাবার বিবিএ পড়ুয়া ছেলে সাদ্দাম, ব্যবসা জীবনের প্রথম দিনটি এভাবেই অতিবাহিত করেছিলো! তা নিয়ে কত মানুষের কত কথা! বন্ধু-বান্ধব প্রতিবেশী থেকে শুরু করে নিজের পরিবার! কথা শোনাতে বাদ রাখেনি কেউই! তবে, এত অপমানের মাঝেও দমে যাননি সাদ্দাম! টাকার জন্য যে বয়সে তরুণরা বিপথগামী হয়, সে বয়সে সাদ্দাম পড়ালেখার পাশাপাশি দিন রাত পরিশ্রম করে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের!
২০১১ সাল। উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি শেষ করে সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ তে ভর্তি হয়েছেন। বাবার দেওয়া হাত খরচের ৩০ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে তাল মেলানো খুব কঠিন! আর মধ্যবিত্ত বাবার কাছে এই বয়সে প্রতিদিন টাকা চাওয়াটা বড্ড লজ্জার। কিন্তু টাকা তো দরকার, নতুবা চলার পথ যে বড় কঠিন!
এমন ভাবনা থেকেই সাদ্দাম, নিজের জমানো টাকা দিয়ে দুই হাজার লিচু ক্রয় করে বিক্রি করতে বসেন রাস্তার পাশের ফুটপাতে। শুরু থেকেই ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থী হওয়ায় ব্যবসার শুরুটা মন্দ হয়নি। প্রথম দিন প্রায় হাজার খানেক টাকার মত লাভ করেন। পরের দিন একই ভাবে লিচু কেনেন এবং বিক্রি করেন। লাভের টাকায় দিনে দিনে লিচু কেনার পরিমান বাড়তে থাকে, আর সে সাথে বাড়তে থাকে লাভের পরিমান টাও।
এভাবেই চলতে থাকে সাদ্দামের লিচুর ব্যবসা! তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই ভয়ংকর অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হতে হয় সাদ্দাম কে! বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে রাস্তায় ফল বিক্রি করে এটা যেন বন্ধু মহল, পরিবার, সমাজ কেউ মেনে নিতে চাইলো না। সবসময় চারপাশের সবাই সাদ্দাম কে নিরুৎসাহিত করার সাথে সাথে অপমানও করতে থাকে! সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাড়ায় পরিবার। তার এহেন কাজ যেন পরিবারের মান-মর্যদাকে একেবারে ধুলির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে, এমনটায় ভাবনা পরিবারের!
সাদ্দাম এসব অপমান আর লাঞ্ছনা-বঞ্চনায় মোটেও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তার সততাই ছিলো তার সাহস। চারপাশের কোন কিছুই আমলে না নিয়ে নিজের মত করে ব্যবসা চালাতে থাকেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সাদ্দামের ব্যবসার পরিসর। লিচু ব্যবসায়ী থেকে সাদ্দাম নিজেকে মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ঋতুর পট পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হতো সাদ্দামের ব্যবসার ধরণ। মাঝে মাঝে ক্ষতির সম্মুখীনও হতেন, তবে তাতে থেমে যান নি সাদ্দাম। উঠে দাড়িয়েছেন। আবার একলাই চলেছেন পথ!
মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে অনেক! ব্যবসার পাশাপাশি সাদ্দাম সফল ভাবে শেষ করেছেন বিবিএ ও এমবিএ। নিজ প্রচেষ্টায় বাড়িয়েছেন ব্যবসার পরিসর। “নিরাপদ ফলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে, আপনাদের পাশে আছি সব সময়” স্লোগানে রাজশাহী মহানগরীর ভদ্রার মোড়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান “ফলশাহী”!
সাদ্দাম জানান, “আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থা উদ্যোক্তা জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের দেশের মাথায়, শিক্ষিত বেকারের বিশাল বোঝার এটাই মূল কারন। শিক্ষিত মানুষ উদ্যোক্তা হলে উদ্যোগ সফল হয় ৯৯ ভাগ। আমি মূলত মৌসুমি ব্যবসায়ী। বেশ কয়েক মৌসুম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি অনেক। তারপরও লেগে থেকেছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন বেশ ভাল একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। ব্যবসার পরিচিতি এবং প্রসারও হয়েছে অনেক বেশি।”
সাদ্দাম আরো জানান, “শূন্য হাতে শুরু করে অনেক কিছু করতে পেরেছি। বেশ কয়েক ধরণের ব্যবসা চলছে বর্তমানে। এর মাঝেই বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেছি।
চাকরির বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে সাদ্দাম জানান, “চাকরি বিষয়টা আমার মাথায় কখনো স্থানই পায়নি। প্রতি মৌসুমে ৮ থেকে ১০ জন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় আমার প্রতিষ্ঠানে, এটা আমার জন্য অনেক বড় অর্জন।”
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে সাদ্দাম জানান, “উদ্যোক্তা জীবন অনেক কঠিনতম জীবন। রাতদিন নিরলস ভাবে পরিশ্রম করা লাগে। আপনি প্রচুর কাজ করবেন, প্রচুর চাপ নেবেন, তবে সবকিছুই হাসি মুখে, এটাই ম্যাজিক। প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার প্রতি পদক্ষেপে থাকে কিছু করুন গল্প! শুনতে রুপকথার মত মনে হলেও গল্পগুলো রুপকথার না। এ গল্প স্বপ্ন দেখার, এ গল্প অকৃত্রিম বিশ্বাসের, এ গল্প পরিশ্রমের, এ গল্প পা হড়কানোর, এ গল্প ধৈর্য্য ধারণের, এ গল্প আত্মবিশ্বাস কে পুঁজি করে উঠে দাড়ানোর, সর্বোপরি এ গল্প চরম সাহসীকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার।”
স/রি