শিশুর শরীরে মরণব্যাধি সৃষ্টি করে করোনা

দেশে সম্প্রতি মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (এমআইএসসি) নামে নতুন একটি মারাত্মক রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। শিশু-কিশোররা সবচেয়ে বেশি এ রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চমাত্রার জ্বর দিয়ে এ রোগের সূত্রপাত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

এর সংক্রমণের মূল কারণ করোনাভাইরাস। এমআইএসসি আক্রান্ত শিশুর রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এতে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। এমন সব তথ্য জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, ২৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যে প্রথম এমআইএসসি রোগটি ধরা পড়ে। এর সংক্রমণ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে দেখা গেছে। ১৫ মে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে সাড়ে তিন মাস বয়সী এক নবজাতকের শরীরে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। মূলত করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কোনো শিশু আসলে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত এভারকেয়ার হাসপাতালে ১৫টি শিশু চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, এ সংক্রমণের সঙ্গে কাওয়াসাকি ডিজিজ এর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। কাওয়াসাকি ডিজিজ হলো এমন এক ধরনের রোগ যা শিশুদের শরীরে জ্বর, চামড়ায় লাল দানা, চোখের প্রদাহ (লাল চোখ), গলা ও মুখগহবর লাল, হাত, পা ফোলা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ করে।

এমআইএসসি রোগের উপসর্গ সম্পর্কে ডা. কামরুল হাসান বলেন, যেকোনো জীবাণু শরীরে ঢুকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ‘সাইটোকাইন’ তৈরি করে। যা শরীরে ইনফেকশন তৈরিতে বাধা দেয়। কিন্তু এমআইএসসির সংক্রমণের ক্ষেত্রে শরীরে অতিমাত্রায় সাইটোকাইন তৈরি হয়। এতে শরীরে প্রবেশকারী জাবাণু নির্মূলের পাশপাশি বিভিন্ন সেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে শরীরের মাল্টি অর্গন আক্রান্ত হয়। যেমন লাংয়ে নিউমোনিয়ার সৃষ্টি হয়, অক্সিজেন কমে যায়, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। হার্টে করোনারি আর্টারি ফুলে যায়। রক্ত জমাট বাধতে শুরু করে। এতে বড়দের মতো শিশুদের হার্ট অ্যাটাক হয়। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এতে প্রসাব অনেক কমে যায়। অন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে ডায়রিয়ার সৃষ্টি হয়। চোখে ও মুখগহবরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়।

এভারকেয়ার হাসপাতালের কনসালটেন্ট (ক্লিনিক্যাল এন্ড ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি) ডা. তাহেরা নাজরীন  বলেন, এমআইএসসি রোগে আক্রান্ত শিশুদের প্রধান লক্ষণ তীব্র জ্বর, ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, বমি, শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা, খাবারে অনীহা, চোখ-ঠোঁট ও জিহ্বা লাল হয়ে যাওয়া। জ্বরের পরে এসব লক্ষণ একই সঙ্গে বা একটি একটি করে দেখা দিতে পারে। এতে শিশুদের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এমনকি নিম্ন রক্তচাপ সৃষ্টি হতে পারে। সঠিক সময়ে হাসপাতালে আনা না হলে রোগীর মারাত্মক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এমনকি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে নিতে হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৭ মে সাড়ে তিন মাস বয়সী একটি মেয়ে ও দুই বছর দুই মাস বয়সী একটি ছেলে এ ধরনের সংক্রমণ নিয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়। চিকিৎসকরা জানান, ভর্তির পর ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত শিশু দুটির শরীরে তাপমাত্রা ১০২ থেকে ১০৭ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে।

এভারকেয়ার হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক এন্ড নেওনেটালজি) ডা. মো. কামরুল হাসান  বলেন, রোগটিতে অল্প বয়সীদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

শিশুর শরীরে এরকম লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এমআইএসসি রোগে আক্রান্ত শিশুর হৃৎপিন্ডে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা গেছে। এতে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

তিনি বলেন, রক্তের সিআরপি পরীক্ষার মাধ্যমে এর সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। অধিকতর নিশ্চিত হতে ফেরাটিন, ডি-ডাইমার ও ট্রপনিন পরীক্ষা করা হয়। তীব্র সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসায় আইভিআইজি (ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনো গ্লোবিইলন) ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়।

এভারকেয়ার হাসপাতালেন শিশু ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাহেরা নাজরীন ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুল হাসান বলেন, এমআইএসসি রোগটি থেকে বাঁচার উপায় হলো- শিশুদের সার্সকোভ-২ ভাইরাস আক্রান্তদের কাছ থেকে দূরে রাখা। বিশেষ করে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সংস্পর্শ সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা।

 

সুত্রঃ যুগান্তর