শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অফিস চলবে অর্ধেক জনবলে

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্কুল, কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে একই রকম ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্ধেক জনবল নিয়ে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল শুক্রবার সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা স্কুল-কলেজ বন্ধ করেছি। সব কিছুই বন্ধ করে দিয়ে দেশকে একেবারে অচল করা যাবে না। অফিস-আদালতে অর্ধেক জনবল দিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটার বিজ্ঞপ্তিও শিগগিরই দেওয়া হবে এবং কার্যকর হয়ে যাবে। ’

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাসহ পাঁচটি জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সশরীরে ক্লাস, পরীক্ষা স্থগিত করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খোলা থাকবে বলে জানা গেছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দেবে, তাদের অবশ্যই টিকা সনদ অথবা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট আনতে হবে।

আরো বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্প-কারখানাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকা সনদ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দায়িত্ব বহন করবে।

এ ছাড়া বাজার, শপিং মল, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সব ধরনের জনসমাবেশে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহারসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। এসব বিষয় স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তদারকি করবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ রয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর বেশ কয়েক ধাপে ছুটি বাড়ানো হয়। প্রায় ১৭ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতিতে শ্রেণি পাঠদান শুরু হয়। দীর্ঘ এই সময়ে টেলিভিশনের পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস চালু রাখা হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংক্রমণ আবারও বেড়ে যাওয়ায় আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি আলোচনায় আসে। তবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাসের টিকা দিয়ে সীমিত পরিসরে শ্রেণি পাঠদান চালু রাখার কথা বলে আসছিলেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেছিলেন, শিক্ষার্থীরা বাড়িতে থাকলেও করোনা আক্রান্ত হতে পারে। এর পরদিনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধের ঘোষণা এলো।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে। তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে। এই মুহূর্তে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ’

পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বন্ধের মেয়াদ আরো বৃদ্ধির ইঙ্গিত ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহ পর পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা কিংবা বন্ধ রাখার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমানোর জন্য সরকার নতুন করে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার এক দিনে প্রায় ১১ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে।

প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ শতাংশ করে রোগী বাড়ছে। এরই মধ্যে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৩৩ শতাংশ শয্যা রোগীতে ভর্তি হয়ে গেছে। ’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব যেভাবে বাড়ছে, তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে বলে আমার মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেহেতু খোলা রাখা হচ্ছে, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করতে হবে। তবে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস দিয়ে সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ’

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা কবে যাবে তা-ও বলা যাচ্ছে না। এ জন্য সুযোগ হলেই সরাসরি ক্লাসে যেতে হবে, আবার করোনা বাড়লে অনলাইনে যেতে হবে। এ জন্য এই অনলাইন ক্লাস কিভাবে জোরদার করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ’

কভিড সংক্রমণ মোকাবেলায় গত ১০ জানুয়ারি সরকার ১১ দফা বিধি-নিষেধ জারি করেছিল। ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করারও ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস ও ট্রেন চালানোর পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার ক্ষেত্রে কভিড টিকার সনদ থাকা বাধ্যতামূলক এবং টিকা সনদ ছাড়া ১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই মানা হয়নি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘প্রতিদিনই রোগী শনাক্তের হার বাড়ছে, যদিও মৃত্যুহার এখনো কিছুটা কম। সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ আমরা এখনো সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। সরকার ১১ দফা বিধি-নিষেধ দিয়েছে, তার পরও মানুষ সেটা মানছে না। ’

এদিকে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও পর্যটনকেন্দ্র খোলা রয়েছে। এ ছাড়া মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলা চলছে। ক্রিকেটের আসর বিপিএলও গতকাল শুরু হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যেকোনো জনসমাগমে যেতে হলে টিকা সনদ নিয়ে যেতে হবে। এটা সব জায়গায় প্রযোজ্য হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় বইমেলা দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বইমেলা ১৫ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে। তবে বইমেলা কিভাবে পরিচালিত হবে, সেখানেও একটি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবী যেভাবে চলছে, যেভাবে বিধি-নিষেধগুলো দিচ্ছে, আমরাও তার বাইরে নই। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা এখনো ভালো আছি এবং এই ভালোটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। ’

জাহিদ মালেক বলেন, ‘বইমেলা, স্টেডিয়াম, বাণিজ্য মেলাসহ সবখানেই এখন থেকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় গেলেও টিকা সনদ নিয়ে যেতে হবে। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রশাসনের। আমরা তাদের আবারও বলব, বিষয়গুলোতে যেন নজরদারি বাড়ায়। ’

মন্ত্রী বলেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে ১০০ জনের বেশি যেতে পারবে না। অবশ্য যেখানে খেলাধুলার বিষয় আসবে সেখানে ১০০ জনের বেশি লোক যাবে না এ কথা বলা যাবে না। কারণ খেলাটা স্টেডিয়ামে হয়। সেখানে টিকা সনদ নিয়ে, টেস্টের সনদ নিয়ে যেতে হবে। এর বাইরে সম্ভব নয়। এটা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বইমেলার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হবে। খেলার স্টেডিয়ামেও টিকা সনদ ও করোনা টেস্টের সনদ দেখিয়ে ঢুকতে হবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের  সব পরীক্ষা স্থগিত

সরকারের নির্দেশনার আলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরীক্ষার সময়সূচি জানানো হবে। ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সশরীরে পাঠদান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে আবাসিক হলগুলো খোলা থাকবে এবং বিভাগগুলো চাইলে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে।

বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা আজ একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, আজ শনিবার কোনো পরীক্ষা থাকলে সেটা নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ