শচিনের এক পোস্টে রাতারাতি তারকা বনে গেছে সাদিদ

কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের প্রোফাইল থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করার পর রাতারাতি তারকা বনে গেছে বরিশালের ক্ষুদে লেগ স্পিনার আসাদুজ্জামান সাদিদ (৬)। ভিডিওটি ফেসবুকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরিশালের মানুষ আনন্দে ভাসতে থাকে। পোস্টটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়। নেট ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন।

শুধু তাই নয়, সকাল থেকেই বরিশাল নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মহাবাজ এলাকার সাদিদের বাড়িতে ভিড় করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ফেসবুকে ভিডিও দেখে কৌতূহলী লোকজন সাদিদের বাড়িতে এসে তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।

রোববার (১০ অক্টোবর) ফেসবুকে ভাইরাল হয় সাদিদের লেগস্পিন বোলিংয়ের একটি ভিডিও ক্লিপ। যা পৌঁছে গেছে কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকারের কাছে। বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) নিজের ফেসবুক পেজে ভিডিওটি আপলোড করে ভারতের ব্যাটিং ঈশ্বর লিখেছেন, ‘ওয়াও! একজন বন্ধুর কাছ থেকে ভিডিওটি পেলাম। এটি অসাধারণ। খেলাটির জন্য এই ছোট্ট ছেলেটির ভালোবাসা ও প্যাশন এখানে সুস্পষ্ট।’

jagonews24

শুক্রবার সকালে সাদিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় লোকজনের ভিড়। ক্ষুদে এ লেগ স্পিনারকে দেখা যায় বাড়ির সামনের রাস্তায় ব্যাট-বল নিয়ে অনুশীলন করছে। এ সময় কথা হয় মো. সীমান্ত খন্দকার (১৮) নামের এক তরুণের সঙ্গে। তিনি এবার ঢাকায় সেকেন্ড ডিভিশন লিগ খেলছেন।

সীমান্ত খন্দকার সাদিদ প্রসঙ্গে বলেন, সাদিদ বয়সে আমাদের থেকে অনেক ছোট। কিন্তু বল করে বড়দের মতো। সে একজন ডানহাতি লেগ স্পিনার। মাপা লাইন-লেন্থের বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের রানের চাকা আটকে দেওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু এনে দিতে পারে। তার জাদুকরি ডেলিভারি ও গুগলি দিয়ে যে কোনো বয়সের ব্যাটসম্যানদের ধোঁকা দিতে পারে। বিশেষত তার গুগলি হেলাফেলা করার কোনো অবকাশ নেই। এ কারণে অন্যকোনো পাড়ার সঙ্গে খেলা হলে সাদিদের ডাক পড়ে। তার বোলিং নৈপুণ্যে নিজের শক্ত জায়গা করে রেখেছে আমাদের মহল্লার দলে।

তিনি আরও বলেন, আগ্রাসী ব্যাটিংয়েও পারদর্শী সাদিদ। ব্যাট হাতে চার-ছক্কা হাকিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে।

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন বছর বয়স থেকেই ক্রিকেটপাগল সাদিদ। টিভিতে ও ইউটিউবে খেলা দেখতে দেখতেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তার। তবে বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাট করতে ভালো লাগতো সাদিদের। ছয় মাস আগেও বোলিংয়ে নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না। সাদিদের মামা সিরাজুল ইসলাম শুভ এক সময় ক্রিকেট খেলতেন। বরিশালে বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন তিনি। মামার কাছেই সাদিদের লেগ স্পিনের হাতেখড়ি।

আরাফাত হোসেন (১৫) নামের এক কিশোর জানায়, সাদিদের বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আছে। তার লেগ স্পিন প্রায়ই ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্তিতে ফেলে। একই বোলিং অ্যাকশনে সে দুই দিকেই বল ঘোরাতে পারে এবং গুগলি ও স্লাইডার করতে পারে। এ কারণে তার বল বোঝা যায় না। ব্যাটসম্যানদের ঘাম ছুটে যায়। তার মতো এখনকার অনেকে বোলিং করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

 

jagonews24

তবে লেগ স্পিন শেখার পেছনে রয়েছে একটি গল্প। বাংলাদেশ দলের একটি খেলায় সর্বোচ্চ রান না করেও সাকিব আল হাসান প্রতিপক্ষের তিন উইকেট শিকার করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। তখন সাদিদের মনে প্রশ্ন জাগে, সাকিব আল হাসান বেশি রান না করেও কীভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হলেন। সাদিদ তার মামার কছে বিষয়টি জানতে চায়। মামার উত্তর ছিল, সাকিব অল রাউন্ডার। ব্যাটের পাশাপাশি ভালো বোলিং করে ম্যাচ জেতায় অবদান রেখেছেন। এ কথা শুনে সাদিদের অলরাউন্ডর হওয়ার ইচ্ছে জাগে। ব্যাটের পাশাপাশি বোলিং প্র্যাকটিস শুরু করে সাদিদ।

সাদিদের মামা সিরাজুল ইসলাম শুভ বলেন, সাদিদের মধ্যে ‘ন্যাচারাল ট্যালেন্ট’ আছে। কোনো কিছু দেখিয়ে দিলে খুব সহজেই রপ্ত করতে পারে। লেগ স্পিন করার জন্য বল কীভাবে ‘গ্রিপ’ করতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছিলাম। গুগলির ডেলিভারিও তাকে দেখিয়েছি। এরপর নিজে নিজেই সে অনুশীলন করে বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করেছে। এখন সে ইচ্ছে করলে এক জায়গায় বল ফেলে সে দুই দিকেই ঘোরাতে পারে।

এলাকায় স্পিনার হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে সাদিদের। এলাকায় কোনো টুর্নামেন্ট হলে সে ডাক পায়। কিছুদিন আগেও এলাকার একটি টুর্নামেন্ট অংশ নেয় সাদিদ। ওই টুর্নামেন্টের একটি খেলায় প্রতিপক্ষের দলের প্রয়োজন ছিল এক ওভারে চার রান। এ সময় সাদিদকে দিয়ে বোলিং করানো হয়। সাদিদ ওই ওভারে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের এক রানও করতে দেয়নি। উল্টো ওই ওভারে দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেয় সে। বোলিং নৈপুণ্যের কারণে সে ওই ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়।

ক্রিকেট ধ্যান-জ্ঞান হলেও পড়াশোনাতেও ভালো এ ক্ষুদে লেগ স্পিনার। এ বছর বাড়ির পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে।

সাদিদের মামা সিরাজুল ইসলাম শুভ বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সাদিদের ভিডিও কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচিন টেন্ডুলকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের প্রোফাইল থেকে ভিডিও পোস্ট করার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকেও ফোন পেয়েছি। আত্মীয়-স্বজনরা ফোন দিয়ে সাদিদকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। গণমাধ্যমকর্মীরা বাসায় ভিড় করছেন। তারা সাদিদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য আনন্দের। আনন্দটা আমার জন্য একটু বেশি, কারণ মেন্টর হিসেবে সাদিদকে ক্রিকেট শিখিয়েছি। শচিন টেন্ডুলকারের ভিডিও শেয়ারের বিষয়টি আমাদের জন্য বিরাট ব্যাপার। অত্যন্ত ভালো লাগছে। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

jagonews24

বরিশাল বিভাগীয় ক্রিকেট কোচ ও সাবেক ক্রিকেটার তাসরিকুল ইসলাম টোটাম বলেন, বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে সাদিদ তার মামার সঙ্গে স্টেডিয়ামে এসেছিল। তার বোলিং নৈপুণ্যের কথা জেনে তাকে স্টেডিয়ামের মাঝখানের উইকেটে নিয়ে বোলিং করানো হয়। তার বোলিং দেখে উপস্থিত সবাই বিস্মিত হয়েছেন। সে আমাকেও বল করেছে। ডানহাতি স্পিনার সাদিদের ঘূর্ণি আমাকেও বোকা বানিয়েছে। তার কয়েকটি বল পড়েছিল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে। ভেবেছিলাম লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়েই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সেই বলটা অবিশ্বাস্য বাঁক নিয়ে প্যাডে আঘাত করেছে। তার গুগলিগুলোও ছিল ভয়ঙ্কর। অফ স্ট্যাম্পে পড়ে বাঁক নিয়ে লেগ স্ট্যাম্পে দিকে আসছিল। বলের গতিও ভালো। সত্যিই এত ছোট বয়সে কাউকে এ ধরনের বোলিং করতে দেখিনি। তার মধ্যে প্রতিভা আছে।

ক্ষুদে লেগ স্পিনার আসাদুজ্জামান সাদিদ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে বলে, শচিন টেন্ডুলকার তার বোলিং দেখেছেন। তার ভিভিও শেয়ার করেছে। এটা দেখে তার খুব ভালো লাগছে। আনন্দ হচ্ছে।

সাদিদ অনুসরণ করেন অসি কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন ও আফগান লেগ স্পিনার রশিদ খানকে। ব্যাটসমান হিসেবে দেশের বাইরে এবি ডি ভিলিয়ার্স ও মাক্সওয়েল তার পছন্দ। আর দেশে মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান। তবে সে বড় হয়ে সাকিব আল হাসানের মতো অল রাউন্ডার হতে চায়। ভবিষ্যতে লাল-সবুজ জার্সি পরে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন সাদিদের।