লেট নাইট পার্টি করা আরো ১০ মডেলের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ

মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেপ্তারের পর ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেট নাইট পার্টি করে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করা আরো ১০-১২ জন মডেলের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা দু’একটি বিজ্ঞাপন ও ইউটিউবভিত্তিক নাটকে অভিনয় করে নিজেদের সামান্য পরিচিত করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ে নামে। নিজেদের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয়। নিজেদের মধ্যে একটি চক্র গড়ে তুলে এসব মডেলরা ব্ল্যাকমেইলিং করে ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা।

ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, চক্রের অধিকাংশ সদস্য ঢাকার বাইরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা মডেল হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীতে আসেন। ছোট কয়েকটি বিজ্ঞাপনে কাজ করার পর নিজেদের মডেল হিসেবে তেমন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আবার অনেকে ইউটিউবভিত্তিক কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে নিজেদের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে এমন ৮-১০ জন কথিত মডেল একত্রে একটি চক্র গড়ে তোলেন। যার অন্যতম সদস্য ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ।

আরো জানা যায়, এ চক্রের সদস্যরা বিজ্ঞাপন ও নাটকে কাজের সুবাদে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পার্টিতে যেতেন। সেখানে গিয়ে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতেন। ধনীর দুলালদের সঙ্গে সখ্যতার পর অনেক ক্ষেত্রে পার্টির পর তাদের সঙ্গে রাত কাটাতেন। লিপ্ত হতেন অসামাজিক কাজে। কথিত এসব মডেলদের মধ্যে অনেকে লেট নাইট পার্টির দৃশ্য মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করতেন।

পার্টি শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরে এসব ধারণ করা ভিডিও এসব ধনীর দুলালদের পাঠিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করতেন চক্রটির সদস্যরা। এদের মধ্যে অনেকেই নিজদের মান-সম্মান ও সামাজিক মর্যাদার ভয়ে চক্রটিকে টাকা দিয়ে ভিডিও ডিলিট করাতেন। আর যারা টাকা দিতে রাজি হতেন না তাদের পরিবারের লোকজনের কাছে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিত। বাধ্য হয়ে টাকা দিতেন অনেকে।

ডিবি সূত্রে জানা যায়, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের মোবাইল পরীক্ষা করে এমনই কয়েকটি ভিডিও পাওয়া গেছে। এসব ভিডিও দিয়েই মূলত ব্ল্যাকমেইল করা হতো।

ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলের বারে কিংবা পার্টি সেন্টারে এসব মডেলদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই লেট নাইট পার্টি হতো। এসব পার্টিতে সমাজের বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা আসতেন। তারা মদ্যপান ও নাচ-গান করে রাত কাটাতেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এ চক্রের সঙ্গে নিয়মিত লেট নাইট পার্টিতে যেতেন এমন ১০ ধনীর দুলালকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলেও তাদের কড়া নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ।

মডেল চক্রের বিষয়ে ডিবি দক্ষিণের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, এমন একটি চক্র রাজধানীতে সক্রিয় আছে জানতে পেরে তারা বারিধারা থেকে পিয়াসা ও মোহাম্মদপুর থেকে মৌকে গ্রেপ্তার করেন। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের বিষয়ে অনেক তথ্যই তারা জানতে পেরেছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে তারা পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

হারুন অর রশীদ বলেন, ‘পিয়াসা ও মৌ দুজনই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এদের অধীনে রয়েছে ১০০-১৫০ লাস্যময়ী। টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে তাদের বাগে আনতেন তারা। পরে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। মান-সম্মানের ভয়ে ওই ব্যক্তিরা কারো কাছে মুখ খোলেননি। পিয়াসা এবং মৌ-এর ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হবে।

সূত্র বলছে, পিয়াসা রাজধানীর বারিধারা, উত্তরা এবং গুলশানের কয়েকটি বাসায় মাঝেমধ্যেই পার্টির আয়োজন করতেন। ওই পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। প্রতিটি পার্টিতেই গোপন ক্যামেরা বসাতেন পিয়াসা। রাখা হতো মদ, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। একপর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে কৌশলে তাকে গোপন একটি কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে ওইসব দৃশ্য সামনে রেখেই তার কাছ থেকে নিয়মিতভাবে হাতিয়ে নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের অর্থ। সর্বশেষ একটি অভিজাত বিপণিবিতানের মালিকের স্ত্রীর সঙ্গে অন্য এক ব্যক্তির কথিত সম্পর্কের বিষয়টিকে পুঁজি করে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল পিয়াসা গং। তবে তিনি বেঁকে বসায় সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ভিত নড়ে যায় তাদের অপকৌশলের। তবুও অভিযানকারী কর্মকর্তাদের শুরুর দিকে দফায় দফায় হুঙ্কার ছেড়েছেন পিয়াসা। হুমকি দিয়েছিলেন তাদের দেখে নেওয়ার।

যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, এ চক্রটির অদ্যোপান্ত আমরা বের করব। বনানীর রেইনট্রি হোটেলের নেপথ্য ভূমিকা ছিল পিয়াসার। তার বিষয়ে অনেক অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। সব তথ্যই আমরা আমলে নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি।

রবিবার (০১ আগস্ট) রাতে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ৯ নম্বর রোডে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় পিয়াসার ঘরের টেবিল থেকে চার প্যাকেট ইয়াবা জব্দ করে ডিবি। পরে তার রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে ৯ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। অভিযানের একপর্যায়ে ফ্রিজ খুলে একটি আইসক্রিমের বাক্স থেকে সিসা তৈরির কাঁচামাল ও বেশ কয়েকটি ই-সিগারেট পাওয়া যায়। ডিবির একই দল রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের  ২২/৯ নম্বর বাড়ির নিচতলায়  আরেক মডেল মৌ-এর বাসায় অভিযান চালায়। ড্রয়িংরুমের পাশেই একটি মিনি বার পায় ডিবি। বাসার ভেতরের বেডরুমের একটি ড্রয়ার থেকে পাঁচ প্যাকেট ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।

ডিবির সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের মে মাসে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে নাম ছিল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার। সেই মামলার আসামি তার সাবেক স্বামী বলেও দাবি করেন পিয়াসা। এনটিভির রিয়ালিটি শো ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন’র প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া পিয়াসা দু-একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেন। কয়েক বছর ধরে হাই সোসাইটিতে ব্ল্যাকমেইলিং কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। মৌ মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠা পাননি। তবে মডেল পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কয়েকটি পরিবার পুলিশের কাছে পার্টির ফাঁদে ফেলে জিম্মি করে টাকা এবং বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের অভিযোগ করেছে। তবে সেসব পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করেননি ডিবির কর্মকর্তারা।

সোমবার গুলশান থানায় দায়ের করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পুলিশের মামলায় পিয়াসাকে এবং মোহাম্মদপুর থানায় একই আইনে পুলিশের মামলায় মৌকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত দুজনেরই পৃথকভাবে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আবেদনে মৌ-এর বাসায় নাচ ও গানের আসরের আড়ালে টাকার বিনিময়ে মদ-ইয়াবার কারবারে আরো দুই-তিনজন জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। পিয়াসার বাসায় বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য উদ্ধারের পর তথ্য পাওয়া গেছে মাদকবিক্রেতা ও সেবনকারী চক্রে তার সম্পর্ক আছে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ