লালপুরে তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা

 লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি:
নাটোরের লালপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠগুলোতে আবাদ মৌসুমভেদে দোল খায় গম ও ধানের শীষ। ধান, গম, রসুনসহ রবি ফসল উৎপাদনে উপজেলায় অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান। তবে নায্যমূল্য না থাকায় কয়েক বছর ধারাবাহিক লোকসানের কারণে স্থানীয় কৃষকরা ধান-পাটের বদলে তামাক চাষ শুরু করছেন। তামাক চাষ করে এর বিঘা প্রতি খরচের প্রায় ১৫ গুণ মুনাফা তুলছেন চাষীরা। এতে অন্য কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন তামাক চাষে।

ফসলি জমিতে তামাক চাষ বাড়ায় কমে যাচ্ছে উর্বরতা শক্তি। তামাকের বিষক্রিয়ায় পরিবেশে বিরূপ প্রভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন সাধারণ মানুষ। মৌসুমী ফসল চাষে শ্রমিকের মূল্য ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকরা প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য ঝুঁকি জেনেও ফলে অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষ করছেন বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, তামাক চাষিদের এক বিঘা জমিতে তামাক চাষের জন্য (বীজ, সার ক্রয়ের জন্য) নগদ ৪ হাজার ২০০ টাকা ও উৎপাদিত তামাক ন্যায্য মূল্যে কৃষকের বাড়ি থেকে ক্রয় করার নিশ্চিয়তা দেয় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি। সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রণোদনা তো দূরের কথা নায্যমূল্যে নিশ্চিতের ব্যবস্থাও নেই। তবে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস ও তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষক্রিয়ার ফলে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাবসহ নিজেদের শ্বাসকষ্টজনিত অসুখের কথা স্বীকার করেছেন চাষীরা।

লালপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বেশ কয়েক বছর ধরে এই উপজেলায় তামাক চাষ হচ্ছে, তবে তা ছিল সীমিত পরিমাণে। তবে বিগত কয়েক বছরে এই চাষ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের হিসেব মতে ২০১৭ সালে উপজেলায় প্রায় ৩৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ হেক্টরে দাঁড়ায়। ২০১৯ ও ২০২০ সালে তামাক চাষের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৪৫ হেক্টর। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলে জানান কৃষকরা।


নিশ্চিত বিক্রি, বেশী মুনাফা ও ক্রেতা কোম্পানী প্রদত্ত প্রণোদনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে চাষীরা তামাক চাষ করছেন। খাদ্যশস্যের সাথে তুলনামূলক বিচারেও তামাক চাষের মুনাফা অনেকগুণ বেশী। এক বিঘা জমিতে ধানের আবাদে খরচ হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। জমি থেকে প্রায় ২০ মন ধান পাওয়া যায় যার প্রতিমন ৮০০ টাকা দরে বর্তমান বাজারমূল্য ১৬ হাজার টাকা।

অপরদিকে, এক বিঘা জমিতে তামাক উৎপাদনে ব্যয় হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। চুক্তিবদ্ধ কোম্পানী চাষীদের এই উৎপাদন ব্যয়ও আগাম প্রদান করে। একই জমিতে তামাক চাষ করলে বিঘাপ্রতি ৪০০ কেজি তামাক পাতা উৎপাদন সম্ভব যা বর্তমানে প্রতিকেজি ১৫৫ টাকা হিসেবে প্রায় ৬২ হাজার টাকা বাজারমূল্য। এক বিঘা জমিতে ধানের তুলনায় তামাক চাষ করলে ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়া যায়।

সরেজমিন উপজেলার গন্ডবিল, বাওড়া, বড়ময়না, বাঁশবাড়িয়া, চন্ডিগাছা, সালামপুর, আব্দুলপুর, দুড়দুড়িয়া, দুয়ারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এক সময় যেসব জমিতে ধান, গম, সরিষাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ফসলের চাষ করা হতো, এখন সেসব জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।
কৃষকরা অন্য ফসলের পাশে চাষকৃত তামাকের জমিগুলো পরিচর্যা করছেন। ইতিমধ্যে তামাকপাতা কাটা ও পোড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে, তাই জমির পার্শে¦ লোকালয় ও কৃষকের বাড়িতে তামাক পোড়ানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছে চুল্লি। বীজ, সার ও অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় ধান ও রবিশস্যের পরিবর্তে তামাক চাষকেই অধিক লাভজনক মনে করছেন তারা।

দুয়ারিয়া গ্রামের তামাকচাষি জমশেদ আলী জানান, তামাক চাষ করতে আমাদের কোনো টাকা লাগে না বরং কোম্পানির লোক টাকা, সার, বীজ দেয় আবার তামাক লাগানোর সময় দামও বলে দেয়। এমন কি কোম্পানি নির্দিষ্ট স্থান থেকে নগদ টাকা দিয়ে তামাক কিনে নেয়। সেই জন্যে এবার আমি তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি।

বাওড়া গ্রামের তামাকচাষি আবুল হোসেন বলেন, বর্তমানে শ্রমিকের দাম অধিক, যে টাকা খরচ করে অন্য ফসল চাষ করি বাজারে সঠিক দাম না থাকায় বিক্রি করে সে টাকা উঠে না। অল্প খরচে কোম্পানির টাকায় তামাক চাষ করে অধিক লাভ হয় তাই তামাক চাষ করেছি।

স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা জানতে চাইলে বলেন, যখন তামাকের কাঁচা পাতাগুলো গাঁথি তখন গন্ধে খারাপ লাগে। কিন্তু কি করব এখন তো খেয়ে বাঁচি পরে যা হওয়ার হবে।

লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম তামাক চাষ বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে বলেন, কৃষি জমি এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য তামাক চাষ ক্ষতিকর। তবে তামাক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কৃষকদের বিনামূল্যে তামাকের বীজ, সারসহ অনেক সময় ঋণও দেন। বিনা পুঁজিতে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকেরা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এই জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের বিভিন্নভাবে সচেতন করেও তামাকের চাষ কমছে না।

স/জে