লন্ডনে এসে যেভাবে খুনি হয়ে উঠলো খুরাম বাট

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

যুক্তরাজ্যে লন্ডন ব্রিজের উপর পথচারীদের উপর লরি উঠিয়ে দিয়েছিল যে তিনজন তরুণ এবং তার পর কাছেরই একটি বাজারে গিয়ে লোকজনকে ছুরি মেরেছিল তাদের নেতা ছিল খুরাম বাট।

দুবছর আগে ৩রা জুন চালানো ওই হামলায় মোট আটজন নিহত এবং আরো প্রায় ৫০ জনের মতো আহত হয়। পরে পুলিশের গুলিতে ওই তিন তরুণও প্রাণ হারায় এবং দেখা যায় তারা ভুয়া বিস্ফোরক ভেস্ট পরিহিত ছিল।

রিংলিডার খুরাম বাট তার কিশোর বয়সেও ছোটখাটো নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। তার মধ্যে ছিল গাজা খাওয়াও। বড় হওয়ার পরেও তার চরিত্রের এসব কিছুই অটুট ছিল বলে নিহতদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের তদন্তে দেখা গেছে।

খুরাম বাটের জন্ম পাকিস্তানের ঝেলুমে, ১৯৯০ সালে। তার আরো একটি বড় ভাই ও বোন আছে। তার পিতা আসবাবপত্রের ব্যবসা চালাতেন। বাটের বয়স যখন আট তখন তারা পর্যটক ভিসা নিয়ে ১৯৯৮ সালে ব্রিটেন এসেছিলেন।

এই পরিবারটি বসবাস করতো পূর্ব লন্ডনের ফরেস্ট গেট এলাকায়। তিনটি সন্তানই সেখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছে। এবং তারা সবাই পড়ালেখায় মোটামুটি ভাল ছিল।

পরিবারটি প্রথমে ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিল যা প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু পরে ২০০৮ সালে হার্ট অ্যাটাকে পিতার মৃত্যুর পর খুরাম বাটকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।

স্কুলের পরে সে একটি পিৎজার দোকানে ক্যাশিয়ারের কাজ করতো। পরে সে লন্ডনের ব্যস্ততম শপিং এলাকা অক্সফোর্ড স্ট্রিটে টপশপ নামের একটি দোকানে চাকরি পায়।

তার বয়স যখন ১৮ তখন বন্ধুর পেমেন্ট কার্ড ব্যবহার করে যানবাহনে চড়ার কারণে পুলিশ তাকে প্রথমবারের মতো সতর্ক করে দিয়েছিল।

কিশোর বয়স থেকে বাট বিভিন্ন ক্লাবে যাওয়া আসা করতো, মাদক গ্রহণ করতো, যৌন কাজে লিপ্ত ছিল। তখন থেকেই মনে করা হতো সে যেন একজন ‘গ্যাংস্টার হয়ে উঠছে।’ আরো পরে ২০০৯ সালে সে একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। পূর্ণকালীন চাকরি করার সময়েও সে বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো অপরাধমূলক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে।

২০১০ সালে, তার বয়স যখন ২০, তখন একটি শপিং সেন্টারে দেহরক্ষীর উপর হামলা করার কারণে পুলিশ তাকে দ্বিতীয়বারের মতো সতর্ক করে দেয়। এর দুবছর পর তার বোন হালিমার বিয়ে হয়ে যায়।

ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে তার সাথে হাশিম রহমান নামের এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়। হাশিমের চাচা বাটের পিতার সাথে কাজ করতেন। এর পর থেকে খুরাম বাট তার সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করে। সেসময় সে ইসলামি বই পড়তে শুরু করে। তখন সে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো।

সেসময় খুরাম বাটের একজন বান্ধবী ছিল। কিন্তু সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি না হওয়ায় বাট ওই সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।

হাশিম রহমান পুলিশকে জানিয়েছেন যে ইসলামি বইপত্র পড়ার পর খুরাম বাট অনেক বদলে যায়। শুরুর দিকে সে খুব নরম মনের মানুষ ও বিনয়ী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। খুরাম বাট পরে হাশিম রহমানের বোন জারাহকে বিয়ে করে।

ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার আগ্রহের শুরুর দিকে সে নিয়মিত মসজিদে যেত এবং সেখানে অবস্থান করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা চরমপন্থি চিন্তাভাবনার দিকে মোড় নিতে শুরু করে।

জারাহর সাথে বিয়ের দিন খুরাম বাট বলেছিল যে তাকে বোরকা পরতে হবে। এমনভাবে থাকতে হবে যাতে একমাত্র সে-ই তাকে দেখতে পারে।

বিয়ের পর সে স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে পাকিস্তান বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে আসার পর সে স্ত্রীকে নিয়ে একটি বাড়িতে ওঠে যেখানে তার মা এবং ভাই ও ভাই-এর স্ত্রী বসবাস করতো।

খুরাম বাটের ভাই সাদ বলেছেন, তার ভাই নববিবাহিত স্ত্রীকে বাড়িতেও পুরো মুখ ঢেকে রাখার নিকাব এবং হাতে গ্লাভস পরতে বলতো।

“এ থেকেই সব বোঝা যায়। সে সবকিছুই ১০০% করতো। আগে সে যার তার সাথে যৌন সম্পর্ক করতো, অনেক বান্ধবী ছিল, মাদক গ্রহণ করতো। পরে যখন সে ধর্মের দিকে চলে গেল তখনও সেটাও সে ১০০% করতে চাইতো,” তদন্তকারীদের কাছে একথা বলেন খুরাম বাটের ভাই।

সাদ বলেন, তার ভাই-এর এই চরমপন্থি মনোভাব তার ভাল লাগতো না। তিনি জানান, সে তার বোনের সাথেও রাগারাগি করতো। সে যখন হিজাব না পরে বাড়িতে আসতো তখন সে রাগ দেখাতো।

বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানের যে ভিডিওতে খুরাম বাটকে নাচতে দেখা যায় সেটা সে তার বোনকে ডিলিট করে দিতে বলেছিল।

পরে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুরাম বাট তার স্ত্রীকে নিয়ে পূর্ব লন্ডনের বার্কিং এলাকায় এক বেডরুমের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে চলে যায়।

খুরাম বাট ওই ফ্ল্যাটের হলওয়েতে একটি পর্দা ঝুলিয়ে দেয় যাতে অন্যেরা তার স্ত্রীকে দেখতে না পারেন।

“বন্ধুদের সাথেও সে ১০০% কড়া আচরণ করতো। তারা আমাকে দেখুক এটা সে চাইতো না,” বলেন খুরাম বাটের স্ত্রী।

তার বাড়িতে প্রায়শই বন্ধুদের আড্ডা বসতো। খুরাম বাটের স্ত্রী তাদের জন্যে রান্না করতেন। পরে স্বামীর বন্ধুরা কখনো কখনো সারা রাত থেকে যেত এবং তিনি শোওয়ার ঘরে ল্যাপটপে টেলিভিশন দেখতে দেখতে বাকি রাত কাটিয়ে দিতেন।

তিনি জানান যে ২০১৪ সালে তাদের একটি বাচ্চা হয়। তখন কিছুটা সময় খুরাম বাট তাদের বাচ্চাকে নিয়েই থাকতো। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তার সব মনোযোগ চলে যায় সিরিয়ার যুদ্ধের দিকে।

খুরাম বাট যে কেএফসিতে কাজ করতো তার ম্যানেজার জানিয়েছেন যে তারাও তার আচরণে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন।

বাট তার মাথা ন্যাড়া করে ফেলে। দাড়ি রাখতে শুরু করে।

বাটের এক সহকর্মী জানান, তার সাথে একবার ব্রিটিশ সৈন্য লী রিগবিকে হত্যার ঘটনা নিয়ে কথা হয়েছিল। সেসময় বাট বলেছিল এটা হচ্ছে “চোখের বদলে চোখ নেওয়ার” মতো প্রতিশোধমূলক ঘটনা।

খুরাম বাটের স্ত্রী জানান, ২০১৪ সালের শেষের দিকে তার স্বামী অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর কারণে অত্যন্ত পরিচিত আঞ্জেম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে।

সেসময় তিনি তার স্বামীকে এধরনের লোকজন থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি জানান যে খুরাম বাট এসব কথা কানেই নিতো না। লোকজনের কথাকে সে পাত্তা দিতো না। সে যা ভালো মনে করতো সেটাই সে করতো।

তিনি আরো জানান যে তার স্বামী পরে মি. চৌধুরীর সাথে দেখা করেন। এর পর থেকে সে ইউ টিউবে মি. চৌধুরীর বক্তৃতা শুনতো এবং একবার সে তাকে বাড়িতেও দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছিল।

খুরাম বাটের একজন বন্ধু জানিয়েছেন, আঞ্জেম চৌধুরীর সংস্পর্শে সে খুব ‘চাঙ্গা’ হয়ে ওঠে। এই বন্ধুটি তাকে “খাঁচার বাইরে থাকা সিংহের” সাথে তুলনা করেন।

ইসলামের প্রতি গভীর আগ্রহের পরেও সে মাদক গ্রহণ ও অন্যান্য ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখে।

তার আরেক আত্মীয় ওসমান দার ২০১৫ সালে এন্টি-টেররিস্ট হট-লাইনে ফোন করে খুরাম বাটের ব্যাপারে রিপোর্ট করেছিলেন। কারণ ইসলামিক স্টেটের জিহাদিরা যখন জর্ডানের একজন পাইলটকে খাঁচার ভেতরে আটকে আগুন দিয়ে হত্যা করেছিল তখন খুরাম বাট এই হত্যাকে সমর্থন করেছিল।

বাটের সাথে তার স্ত্রীর বড় রকমের ঝগড়া হয় ২০১৫ সালের শেষের দিকে যখন সে আরো একটি বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেসময় রাগ করে তার স্ত্রী এক মাসের জন্য বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল।

সেসময় চ্যানেল ফোর টেলিভিশনে ‘জিহাদি নেক্সট ডোর’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ চরমপন্থির কথা তুলে ধরা হয়। তাতে খুরাম বাটকে দেখা যায় লন্ডনের রিজেন্ট পার্ক পুলিশের সাথে তর্ক করতে।

বাটের স্ত্রী জানান, তার বাবা মায়ের বাড়িতে অবস্থানের সময় তিনি এই তথ্যচিত্রটি দেখেছিলেন। তার স্বামী তাকে এবিষয়ে কিছু বলেনি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে খুরাম বাটের মধ্যে পশ্চিমা-বিরোধী কড়া মনোভাব গড়ে ওঠে।

হোয়াটস্যঅ্যাপে সে শিরশ্ছেদের ভিডিও শেয়ার করতো। এবং মসজিদ থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

তার বড় ভাই সাদ বলেন, “পররাষ্ট্র নীতি, যুদ্ধ, বিদেশিদের প্রতি অবিচার এসব বিষয় নিয়ে খুরাম বাট ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।”

তিনি জানান, এসব নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছিল। এবং এরপর থেকে বাট তাদের সাথে সিরিয়া বিষয়ে কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়।

সেসময় পরিবারের সদস্যরা মনে করেছিল যে হয়তো বাটের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সে তখন আসলে গোপনে গোপনে সন্ত্রাসী হামলারই পরিকল্পনা করছিল।

এর কয়েক মাস পরেই খুরাম বাট তুরস্কে যাওয়ার টিকেট কাটলে তার স্ত্রীর পরিবার তাদের পাসপোর্ট সরিয়ে নেয়।

বাটের স্ত্রী তার পিতামাতাকে জানান যে তার স্বামী ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়ার জন্যে তাকে ও তার সন্তানকে সিরিয়াতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে তিনি সন্দেহ করছেন।

পরে তার পিতা তাদের ডকুমেন্ট ধ্বংস করে ফেলেন।

খুরাম বাট ২০১৬ সালে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে কাস্টমার সার্ভিস সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।

তার স্ত্রী ও পরিবার এতে খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই সে অসুস্থতার কথা বলে অর্থ দাবি করতে থাকে।

তার স্ত্রী বলেন, “তার কোন অসুস্থতা ছিল না। আসলে সে কোন কাজ করতে চাইতো না।”

কিন্তু খুরাম বাট তার এক আত্মীয়ের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় তাকে বলেছিল সে এই কাজ করতে চায় না কারণ গ্রীষ্মকালে চারপাশে অনেক নগ্ন নারী চলাফেরা করে।”

পরে তাকে ওই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। সেসময় যখন সে বাড়িতে ফিরতো তখন তার গা থেকে গাজার গন্ধ পাওয়া যেত।

খুরাম বাটের স্ত্রী জানান, তার স্বামী যখন অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে ছিল তখন সে একটি ফিটনেস সেন্টারে যেত।

ওই সেন্টারটি যারা চালাতো তাদের একজন ইলফোর্ড এলাকায় আদ-দ্বীন প্রাইমারি স্কুলের হেডটিচার হিসেবে কাজ করতেন।

খুরাম বাটকে তারা অনুরোধ করেছিল ওই স্কুলে বাচ্চাদের কোরান পড়াতে।

সে তখন ছয় থেকে সাতজন বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করে। প্রত্যেকদিন দুপুরে সে দু’ঘণ্টা করে পড়াতো। পরে স্কুলটি ২০১৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

লন্ডন ব্রিজে হামলা চালানোর কয়েক সপ্তাহ আগে খুরাম বাট আরো এক সন্তানের পিতা হন। কিন্তু তার স্ত্রী জানান এসময় তার কিম্বা পরিবারের ব্যাপারে বাটের কোন আগ্রহ ছিল না।

তিনি জানান, তার দ্বিতীয় সন্তানের যখন জন্ম হলো তার কয়েক মিনিট পরেই বাট জিমে যাওয়ার কথা বলে হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছিল।

কিন্তু পরে জানা যায়, হামলায় আরো যারা অংশ নিয়েছিল সেদিন সে তাদের সাথে মিটিং করতে গিয়েছিল।

তার স্ত্রী তাকে বাড়িতে সময় দিতে বারবার অনুরোধ করেছিল কিন্তু খুরাম বাট তাতে কোন কান দেয়নি এবং ২০১৭ সালের ৩রা জুন, শনিবার সে বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বের হয়ে গিয়েছিল।

পরিবারের কাউকে বিদায় না জানিয়ে বাচ্চাদের চুমু না খেয়ে সেদিন সে বের হয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।

পরে তার নেতৃত্বে চালানো সেদিনের ওই হামলায় আটজন নিহত হয়।