রোগী সুস্থ হলে দিনশেষে অনেকেই ধন্যবাদ পায়, কিন্তু আমরা পাই না

করোনার এ দুর্যোগে মানুষ যখন মানুষের পাশে থাকে না, যখন একজন মুমূর্ষু রোগীর আত্মচিৎকারেও কেউ এগিয়ে আসে না, ঠিক তখনই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। সেটি রোগীর স্বজনের ফোনকলই হোক বা প্রশাসনের মাধ্যমেই হোক। পেশা ও মানবিকতার টানে ছুটে আসতেই হয় তাদের।

এরপর আক্রান্তদের খুব কাছে গিয়ে সেবা দিয়ে থাকেন তারা। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে অনেকের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখান অ্যাম্বুলেন্স চালকরাই। তখন শ্রদ্ধায় মাথা নত হওয়ার কথা থাকলেও দিনশেষে ধন্যবাদটাও জুটে না অনেকের কপালে।

তাদেরই একজন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক তৌহিদুর রহমান টিপু। ২৯ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে আসছেন তিনি। দীর্ঘদিন পর কেউ একজন নিজের জীবনের কথা শুনতে চাওয়ায় মন খুলে কথা বলেন টিপু। তুলে ধরেন জীবনের পাওয়া, না পাওয়া, তৃপ্তি ও কষ্টের কথাগুলো

Jhenaidah-Ambulance-driver-2

টিপু এ প্রতিবেদককে বলেন, ঝিনাইদহে মহামারি করোনাভাইরাস প্রথম ধরা পড়ার পর অফিস আমাকে চিঠি দেয় করোনা আক্রান্ত রোগী বহন করা প্রসঙ্গে। এরপর আমি মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙে পড়ি। তখন পরিবারের সদস্যরা আমাকে সাহস দেয়।একদিকে আমার স্ত্রী সন্তানের সংসার এবং জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন। অন্যদিকে, দ্বায়িত্ব। এরপর মন শক্ত করি।দায়িত্বের প্রশ্নে পিছপা না হওয়ারও শপথ করি।তারপর প্রতিদিনের মতো সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে যাই। এরপর অপেক্ষায় থাকি কখন বেজে উঠবে ফোন। ফোন বেজে উঠলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে।

তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সবার আগে রোগীর কাছে ছুটে গিয়ে তার বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয়। এসময় দেখি রোগীর পরিবারের সদস্যরা কেউ তার পাশে নেই। অসহায় অবস্থায় ঘরের এক কোণে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে রোগী। যে গ্রামে বা এলাকায় কেটেছে রোগীর শৈশব সেই প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনরা বলে রোগীকে দ্রুত গ্রাম থেকে নিয়ে যান, ওর জন্য আমরা সবাই মারা যাব। ওই সময়টা এতই কষ্টকর যে বোঝাতে পারবো না।

এভাবেই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে বহন করে হাসপাতালে এবং বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন তৌহিদুর রহমান টিপু।

তিনি জানান, রোগীদের কাছে গিয়ে সেবা দেয়ার জন্য তিনি নিজেও করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন।তবে রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।

Jhenaidah-Ambulance-driver-1

টিপু বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি কাজ পাগল মানুষ।কোনো কাজ দেখে ভয় পাই না। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার কোনো সমস্যা হবে না। মনের শক্তি থেকেই মানুষের সেবা করছি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজের মধ্যেই থাকি। কাজ শেষে গাড়ি পরিষ্কার করে পোশাক পুড়িয়ে ফেলে রাতে বাড়ি ফিরি। রাতে ঘুম আসতে চায় না। করোনার বিভীষিকা, রোগীদের আতঙ্ক, অস্থিরতা আর সব সময় মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের মুখগুলো চোখের সামনে ভাসে। ভীষণ কষ্ট লাগে, মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে এসব মানুষকে দেখে।

তিনি আরও বলেন, এ কাজ করায় এলাকাবাসী আমাকে দেখে ভয় পায়। এমনকি অফিসরুমে গেলে স্টাফরা আমাকে বলেন আপনি এখানে এসেছেন কেন, বাইরে যান।এসব কথা শুনে খুব খারাপ লাগে। ভাবি কাদের জন্য এতকিছু করছি। তবে আমার পরিবার আমাকে সাহস দেয়। তারা কখনও আমাকে দেখে ভয় পায় না। তারা বলে, মরলে একসাথে মরবো আর বাঁচলে একসাথে বাঁচবো। তারপরও স্ত্রী-সন্তানসহ সবাই আমাকে নিয়ে আতঙ্কে দিন পার করছে।

তবে খারাপ লাগে দিনশেষে যখন সবাই ধন্যবাদ পায় অথচ আমার মতো ছোট পদগুলোতে যারা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে তারা পায় না। দ্রুতগতিতে অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে অথবা বাড়িতে পৌঁছেও দিলেও কেউ বলে না ধন্যবাদ। অথচ তাদের সুস্থতার পেছনে যে আমাদেরও একটু হলেও অবদান আছে সেটা কেউ একবারও ভাবে না।

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ