রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা: এখন অন্য হাসপাতালগুলোও নজরদারিতে আসছে

করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রতারণার নানা অভিযোগ ওঠার পর এখন স্বাস্থ্য বিভাগ সারাদেশে হাসপাতালগুলোতে আকস্মিক পরিদর্শন শুরু করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের পরিদর্শক দল গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় দু’টি হাসপাতালে আকস্মিক পরিদর্শন করেছে এবং করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সব হাসপাতালে আকস্মিকভাবে যাবে পরিদর্শক দল।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা প্রকাশ পাওয়ার প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে উঠেছে এবং মানুষের মাঝে আস্থার সংকট বেড়েছে।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়াসহ চিকিৎসায় প্রতারণার অভিযোগে দু’দিন আগে রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। মামলা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিক শো: শাহেদ ওরফে শাহেদ করিমের বিরুদ্ধে।

এই ঘটনার কিছুদিন আগেই জিকেজি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন জায়গায় বুথ বসিয়ে পরীক্ষার জাল রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগ ওঠে।

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার ইস্যু নতুন করে সামনে এসেছে।

একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: লেলিন চৌধুরী বলেছেন, জিকেজির পর রিজেন্ট হাসপাতাল এবং মো: শাহেদের প্রতারণা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠলেও চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি বলে তিনি মনে করেন।

“আমরা প্রত্যাশা করছিলাম, রিজেন্ট হাসপাতালের এই ঘটনার পর থেকে যে, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোকে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনায় আনতে নিবিড়ভাবে সার্ভেইল্যান্সা করা হবে। এখনও তার কোন লক্ষণ আমরা দেখছি না।”

তিনি আরও বলেছেন, “এটা না করলে মানুষের ভোগান্তি এবং ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।

ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলিয়ে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭১টি প্রতিষ্ঠানই যথাযথ মানসম্পন্ন নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেই মানসম্পন্ন নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাল এবং হলুদ হিসাবে চিহ্নিত করে রেখে বলে জানা গেছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা যশোরের খায়রুল ইসলাম স্থানীয় একটি সরকার নির্ধারিত ক্লিনিকে তার পিতাকে ভর্তি করিয়ে চরম অব্যবস্থাপনার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

তিনি বলছেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ায় তিনি তার বাবাকে গত ২৪শে জুলাই যশোর শহরে ক্লিনিকে ভর্তি করান। কিন্তু কোন চিকিৎসা না পেয়ে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

“আমার বাবাকে ভর্তি করানোর পর দু’দিন ডাক্তার একটু রাউন্ড দিয়েছে। তারপর তিনদিন একজন ডাক্তার একদিন এসেছিলেন, তবে তিনি গেটের বাইরে থাকেন এবং রোগীদের বাইরে গিয়ে কথা বলতে হয়েছে। সেখানে তিনি অনেক দূর থেকে প্রেসক্রিপশন করে দেন। এছাড়া তিন দিন ধরে আমার বাবা ধুকে ধুকে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন, তারপরও তারা কর্ণপাত করেন নাই।”

পিতা হারানো যশোরের খায়রুল ইসলামের বক্তব্য হচ্ছে, “ব্যবস্থাপনা যদি এরকম হয়, তাহলে সুস্থ রোগীও মারা যাবে। মনে হলো ঠিক আমার বাবাও এরকম হয়ে মারা গেলো।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর পরই হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার বিষয়টি মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছিল। চার মাস পরও অব্যবস্থাপনার চিত্র মানুষের মধ্যে হাসপাতাল নিয়ে ভীতি আরও বাড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলছিলেন, “রিজেন্ট হাসপাতালে যে ধরণের ঘটনা ঘটেছে, আরও কিছু বেসরকারি হাসপাতালে বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, যেখানে অনেক বেশি বা অস্বাভাবিক বিল করা হয়।এসব ঘটনা মানুষের মধ্যে শংকা তৈরি হয়। অনেকে এখন মানে আমার পরিচিত অনেকে হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছে।”

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা প্রকাশের প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ঢাকায় দু’টি হাসপাতালে আকস্মিক পরিদর্শন করে তারা চিকিৎসার সন্তোষজনক পরিস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।

তারা উল্লেখ করেছেন, এখন করোনাভাইরাসের জন্য নির্ধারিত সব হাসপাতালে পরিদর্শকদল আকস্মিকভাবে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ড: আয়শা আকতার বলেছেন, হাসপাতালগুলোতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

“এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেলো। কারণ আমরা যে বিশ্বাস করেছি, সেই বিশ্বাসটা যে ভেঙে ফেলছে যারা, এটাতো প্রতারণা। এটা অপরাধ। সেজন্য আমাদের নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আব্দুল মান্নান বলেছেন, হাসপাতালগুলো মনিটর করার জন্য একটি কমিটি রয়েছে, সেই কমিটির তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা