রায়হান হত্যা : ১৫ দিনেও অধরা এসআই আকবর

সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ (৩৪) হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভুইয়াকে ঘটনার ১৫ দিনেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি তার বর্তমান অবস্থানও স্পষ্ট হতে পারছে না তারা। দীর্ঘদিন পরও আকবর গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে।

এদিকে গত ২৫ অক্টোবর ছেলের হত্যাকারীদের বিচার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে কাফনের কাপড় বেঁধে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে অনশন করেন রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম।

অনশনের ছয় ঘণ্টার মাথায় সিলেট সিটি কর্পোরেশেনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আকবরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের আশ্বাস দিয়ে অনশন ভাঙান। কিন্তু ওই আশ্বাসের ২৪ ঘন্টাও পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আকবর গ্রেফতার হয়নি।

এছাড়া গত ২৪ অক্টোবর টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, সিলেটের আলোচিত রায়হান হত্যার ঘটনার প্রধান আসামি এসআই আকবরের অবস্থান শনাক্ত হয়েছে। খুব শিগগিরই তাকে গ্রেফতার করা হবে। দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।

কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের তিনদিনেও আকবরকে গ্রেফতারে বরাবরের মতো ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

সিলেট মহানগর পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যার তথ্য বেরিয়ে আসার পর গত ১২ অক্টোবর রাত থেকে পলাতক রয়েছেন এসআই আকবর। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার ব্যবহৃত মোবাইল বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রেখে গেছেন। এছাড়াও কীভাবে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামি ধরা হয় সে বিষয়টিও আকবরের জানা। যার কারণে সে অন্য আসামি থেকে একটু আলাদা। কারণ পুলিশ যে কৌশল অবলম্বন করে তাকে ধরবে সেই কৌশল এসআই আকবর এড়িয়ে চলছেন। তিনি পুলিশের বিশেষ শাখা সিআরটি’র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন কমান্ডো অফিসার। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না। তবে তাকে খুঁজে বের করতে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ উজ জামান জানান, তারা এ হত্যাকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছেন। এর সঙ্গে জড়িতরা যাতে কোনোভাবেই পার না পায়- সে জন্য পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা দিনরাত কাজ করছেন। আকবরকে গ্রেফতারেরও জোর চেষ্টা চলছে।

তবে নির্মম এ ঘটনার ১৫ দিনেও প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে। অপরাধ কর্মকাণ্ডের ‘রাজা’ বলে বহুল আলোচিত আকবর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথায় পালালেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন রায়হানের পরিবারসহ সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

সিলেট নাগরিক আন্দোলনের নেতা আব্দুল করিম কিম বলেন, একজন আকবরের দায় কেন গোটা পুলিশ বাহিনীকে বহন করতে হবে। এসআই আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করে পুলিশ বিভাগ দায় মুক্ত হোক। এটা আমরা মনে-প্রাণে চাই।

উল্লেখ্য, গত ১১ অক্টোবর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে রায়হানের মৃত্যু হয়। রায়হান সিলেট নগরের আখালিয়ার নেহারিপাড়ার বিডিআরের হাবিলদার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি নগরের রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে চাকরি করতেন।

এ ঘটনায় গত ১২ অক্টোবর রাতে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু আইনে নগরীর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।

১৪ অক্টোবর মামলাটি পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশ পিবিআইতে স্থানান্তর হয়। তদন্তভার পাওয়ার পর পিবিআইর টিম ঘটনাস্থল বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, নগরের কাস্টঘর, নিহতের বাড়ি পরিদর্শন করে। সর্বোপরি মরদেহ কবর থেকে তোলার পর পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়।

নিহত রায়হানের মরদেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন উঠে এসেছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিল গুরুতর জখমের চিহ্ন। এসব আঘাতগুলো লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।

এ ঘটনায় গত ২০ অক্টোবর দুপুরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় ওই ফাঁড়ির কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে ও ২৩ অক্টোবর কনস্টেবল হারুনুর রশিদকে গ্রেফতারের পর পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রোববার (২৫ অক্টোবর) কনস্টেবল টিটুকে ফের তিনদিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই।

ঘটনার দিন বিকেলে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় কমিটি। তদন্ত কমিটির সুপারিশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করে তাদের পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়।

এছাড়া গত ২১ অক্টোবর এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে ফাঁড়ি হতে পালাতে সহায়তা করা ও তথ্য গোপনের অপরাধে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির টু আইসি এসআই হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ