রাবির কৃষি প্রকল্প : পছন্দের লোকদের গুরু দায়িত্ব, খয়ের গাছের টেণ্ডারে ধান বিক্রির আদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কৃষি প্রকল্প যেন অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি পুকুর খননের টেণ্ডার হলেও বেশ কয়েকটি পুকুর খনন করে নিয়ম বহির্ভুতভাবে হাজার হাজার ট্রাক মাটি ইটভাটা, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রির ঘটনায় তোলপাড় চলছে। রাতের আঁধারে ট্রাক্টরযোগে মাটি বহনকালে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে একজন নিহতের ঘটনায় চলছে নানা সমালোচনা।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কৃষি প্রকল্পকে অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে নিয়ে যেতে পছন্দের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আবার একই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নির্দিষ্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নির্ধারিত দায়িত্ব না দিয়ে বিধি বহির্ভুতভাবে গুরুত্বহীন স্থানে দায়িত্ব প্রদানের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া কিছুদিন আগে কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত একটি প্রকল্পে খয়ের গাছ বিক্রির টেণ্ডারের আদেশপত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ধান বিক্রির অনুমতিপত্র নেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়; অনুমতিপত্রের মধ্যে আদেশপত্রের মেমো নম্বর ও বিবিধ রশিদের নম্বর ফাঁকা রেখেই কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচু জলাশয় সংস্কার ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পুকুর খননের টেন্ডার হয়েছিল। এছাড়া পরবর্তীতে আরও দুটি পুকুর খননের টেণ্ডার হয়। সবমিলিয়ে তিনটি পুকুর খননের টেণ্ডার হয়েছিল। অথচ টেণ্ডার ছাড়া আরও কয়েকটি পুকুর খনন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুকুর খননের পুনঃকোটেশন বিজ্ঞপ্তির শর্তে উল্লেখ ছিল- জলকর থেকে ৫ ফুট দূরে বকচর এবং বকচর থেকে পাড় বাঁধাই করতে হবে। পাড় বাঁধাই ৩৫ ফুট থেকে শুরু হয়ে পাড়ের চাঁদি ১৫ ফুট প্রস্থ করতে হবে বলেও শর্তে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে- যেসব পুকুর খনন করা হচ্ছে তার কোনোটিতেই এই শর্ত মানা হয়নি। এমনকি বিজ্ঞপ্তির শর্তে আরও উল্লেখ ছিল- পুকুরের পাড় বাঁধাইয়ের পর অতিরিক্ত মাটি সর্বোচ্চ ৩০০ গজ দূরে ফেলে রাখতে হবে এবং উক্ত মাটি কৃষি প্রকল্পের আওতাধীন থাকবে।

অথচ কৃষি প্রকল্পের বিজ্ঞপ্তির এই শর্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা পুকুর খননের প্রায় ১০ হাজার ট্রাক্টর মাটি ক্যাম্পাসের বাইরে ইটভাটায়, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে দিয়েছে। সরেজমিনে প্রতিবেদক ক্রেতা সেজে প্রতি ট্রাক্টর মাটি কত টাকায় ক্রয় করা সম্ভব জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন বলেন ‘আমরা প্রতি ট্রাক্টর মাটি ১৫০০ টাকায় বিক্রি করি। তবে একটি মাদ্রাসায় ট্রাক প্রতি ১৩০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। আপনার নিকট সেই দামই রাখতে পারবো। ট্রাক প্রতি ১৩০০ টাকাতেও বিক্রি হলে রাবি ক্যাম্পাস থেকে যদি আনুমানিক ১০ হাজার ট্রাক মাটি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা বাইরে বিক্রি করে থাকে তাহলে তার মূল্য হবে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

সূত্রে জানা গেছে, রাবির কৃষি প্রকল্পের সহকারি পরিচালক পদে ড. আলী মো. নুসাইরকে গত বছরের ৫ মার্চ নিয়োগ প্রদান করা হয়। এর আগে থেকে কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার আশির্বাদপুষ্ট ও তাঁর সচিব প্রদীপ কুমার রায়। অথচ এক বছর পেরিয়ে গেলেও ড. নুসাইরকে কৃষি প্রকল্পের সহকারি পরিচালকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। তার সকল কাজ এখন পর্যন্ত উপ-উপাচার্যের সচিব প্রদীপ-ই করছেন। আর ড. আলী মো. নুসাইরকে বিশ^বিদ্যালয়ের মতিহার উদ্যান দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে- কৃষি প্রকল্পের সবকিছুতেই নয়-ছয় করতে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার এক লুজ ডকেটের আদেশে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের স্টোরকিপার ও মাঠ সহকারীকে বিশ^বিদ্যালয়ের ‘সাতপুকুর সৌন্দর্য্যবর্ধন ও গবেষণা প্রকল্প’ কাজে নিয়োজিত করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে-বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকল্প উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা নিজের ইচ্ছেমত বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি পরিচালনা করতে তার মমদপুষ্ট প্রদীপ রায় ও সহকারি রেজিস্ট্রার মো. সাজ্জাদ হোসেন ও সেকশন অফিসার মনোয়ার হোসেন উৎপলকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কৃষি বিষয়ে এই তিন কর্মকর্তার বিন্দুমাত্র কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় বছরের পর বছর বিশ^বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কৃষি খাতটি চরম লোকসানে পড়েছে। ফলে স্বায়ত্বশাসিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাঠকর্মী হিসেবে যাকে কৃষি প্রকল্পে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে তিনি কৃষিতে ডিপ্লোমা করেছেন। তার কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ভালো জানার কথা এবং মাঠপর্যায়ে কোন ফসল, কখন কীভাবে চাষ করলে ফলন ভালো হবে সেটি তিনিই ভালো জানেন। অথচ তাকে সাতপুকুর প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। এছাড়া স্টোরকিপারের দায়িত্ব হলো- কোন মৌসুমে কোন ফসল কী পরিমাণে ভাণ্ডারে জমা হচ্ছে তার হিসাব-নিকাশ রাখা। কিন্তু এখানেও নয়-ছয় করতে পারবে না জন্য স্টোরকিপারের দায়িত্ব থেকে তাকে অন্যত্র দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এক বছরের বেশি সময়েও দায়িত্ব বুঝে না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কৃষি প্রকল্পের সহকারি পরিচালক ড. আলী মো. নুসাইর বলেন, ‘এবিষয়ে আমি আসলে কিছু বলতে পারবো না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে যেভাবে যা করতে বলবে আমাকে তাই করতে হবে। আমাকে মতিহার উদ্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমি এখনো কাজ শিখছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ রায় স্বাক্ষরিত খয়ের গাছ কাটার একটি টেণ্ডারে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার মো. বাবু বরাবর একটি আদেশপত্রে বলা হয়েছে- ‘কৃষি প্রকল্পের গত ৯ সেপ্টেম্বর তারিখের ২১৭ (২০০)/কৃ:প্র:-৩৪৭/১৯ নং কোটেশন বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে ৭ নং ব্লকের পাসকৃত খয়ের গাছের মূল্য ৪৯ হাজার ৬৭০ টাকা সর্বোচ্চ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।’

অতএব পত্র প্রাপ্তির ৩ দিনের মধ্যে উক্ত ধানসমূহ (খয়ের গাছ ধান হয়ে গেছে) ওজন করে সমুদয় মূল্য কৃষি প্রকল্পের ০১৪২১৯ নং ব্যাংক হিসাবে (অগ্রণী ব্যাংক রাবি শাখার) জমা করে অনুমতিপত্র নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। পরবর্তীতে একই তারিখে দেয়া অনুমতিপত্রের মধ্যে আদেশপত্রের মেমো নম্বর ও বিবিধ রশিদের নম্বর ফাঁকা রেখেই কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেন।

কৃষি প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ রায়ের নিকট একটি প্রকল্পে খয়ের গাছ বিক্রির টেণ্ডারের আদেশপত্রে ‘খয়ের গাছ কীভাবে ধান হয়’ এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এবিষয়ে আমি না দেখে কিছুই বলতে পারবো না। তবে প্রিন্টিং মিস্টেক হতে পারে।’ এছাড়া অনুমতিপত্রের মধ্যে আদেশপত্রের মেমো নম্বর ও বিবিধ রশিদের নম্বর ফাঁকা রেখেই আপনি কেন স্বাক্ষর করেছেন এমন প্রশ্নে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি এসব কাগজ-পত্র কোথায় পেলেন? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মোবাইলে এবিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।’ তখন প্রতিবেদক তার সঙ্গে সাক্ষাতে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য দেখা করতে চাইলে তিনি ব্যস্ত মানুষ, দেখাও করতে পারবেন না বলে জানান।

খয়ের গাছ ধান হয়ে গেল কীভাবে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কৃষি প্রকল্পের সহকারি রেজিস্ট্রার মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘এতো বড় ভুল হওয়ার তো কথা না। তবে ভুল হতে পারে। কিন্তু খয়ের বলে যে ধান নিয়ে গেছে কিংবা ধান বলে যে খয়ের নিয়ে গেছে এমনটা কিন্তু হয়নি। তবে বিষয়টি আমার জানা নেই। আমাদের নির্দিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর নেই। কোনো কারণে এটি ভুল হতে পারে। তবে ব্যাংকে টাকা যে জমা হয়েছে এটি আমি আপনাকে শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটি টেণ্ডার প্রক্রিয়া কিন্তু একা অনুমোদন করি না। তবে এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুকুরগুলোর কাজ সেসব ঠিকাদারকে প্রদান করা হয়েছে তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে। এখন তারা যদি মাটি নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে বাইরে নিয়ে যায় সেক্ষেত্রে আমি একজন কর্মকর্তা হয়ে আমার কিছুই করার নেই। বাইরে মাটি নিয়ে যাওয়ার যে ঘটনা ঘটেছে সেই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে কৃষি প্রকল্পের উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার মোবাইল ফোনে অসংখ্যবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এএইচ/এস