সোমবার , ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

রাজশাহী টিবি হাসপাতালের জমি দখল নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য

Paris
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪ ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের (টিবি) জমির জাল দলিল ও দখল নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। টিভি হাসপাতালের ১৬ শতক জমি দখল নিতে বড় একটি চক্র কাজ করেছে। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে ভুমি অফিস, প্লান পাসের ক্ষেত্রে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ প্রভাবশালীরা এর সাথে জড়িত। আর এই সিন্ডিকেট ডাক্তার নুরুল ইসলাম, আ ন ম মোজাম্মেল হক ও শফিউল্লাহকে সার্বিক সহযোগি করেছে।

সেল্টার হিসাবে আওয়ামী লীগের নেতারা, জাল দলিল করে খাজনা খারিজ করতে বোয়ালিয়া ভুমি অফিসের কর্মকর্তারা ও দখল নিতে ক্যাডার বাহিনী কাজ করে। টিবি হাসপাতালের জমি জাল দলিল করে দখল নেয়া মাস্টার মাইন্ডদেরও নাম সামনে আসছে। মজার বিষয়, গরিমন বেওয়া ১৯৬৩ সালে তার জমি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। কিন্তু এই জমি নিয়ে এতো কিছু হলেও তার পরিবারের লোকজন কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডাক্তার নুরুল ইসলাম, আ ন ম মোজাম্মেল হক, শফিউল্লাহসহ ৬জন টিবি হাসপাতালের ওই জমি কেনার সময় তারা জানতেন এটি টিবি হাসপাতালের জমি। তা সত্তেও তারা সেটি কিনেছেন। কারণ জমিটি কেনার সময় এই চিকিৎসকরা যোগাযোগ করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ শীর্ষ এক নেতার সাথে। কারণ ডাক্তার মোজাম্মেল হক ও নুরুল ইসলাম আওয়ামী পন্থী। তারা আওয়ামী লীগ ঘরনার হওয়ার সুবাদে টিবি হাসপাতালের ওই জায়গা তাদের নিজের নামে করে নেয়া ও সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ডাবলু সরকার ও শীর্ষ নেতার স্মরণাপন্ন হন তিন চিকিৎসক। পরে ডাবলু সরকার ও অপর নেতাকে দুই ভবনে দুটি ফ্ল্যাট দেয়ার চুক্তি হয়। আর সেই চুক্তি বাস্তবায়নে ডাবলু সরকার তাদের লোকজন দিয়ে টিবি হাসপাতালের ওই জমি দখল করে দেয়।

জানা গেছে, ৪৩২৭ নম্বর দলিল মুলে ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট .৫৩৩ একর জমি ৪১ লাখ টাকা দিয়ে কেনেন ডাক্তার নুরুল ইসলাম। .৫৩৩ একরসহ তার মোট ৮শতক জমি কিনতে ৫০ লাখ টাকাও খরচ পড়েনি। রাজশাহীর ভাটাপাড়া এলাকার মাফিজুল ইসলাম এই জমি পাওয়ার অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন কুমিল্লার ফজলুল করিম মজুমদারকে। ফজলুল করিম মজুমদার পাওয়ার অ্যাটর্নির ক্ষমতায় ডা. নুরুল ইসলামের কাছে কৌশলে ও দ্রুত .৫৩৩ একর জমি বিক্রি করে চলে যান। ওই জমির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা।

আবার একই দাগে একই জায়গায় নামমাত্র মূল্যে ৮ শতক জমি আবু ইউসুফ সেলিম, তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম, মাসুদ রানা, জামাল উদ্দিন, মনসুর রহমানের কাছ থেকে ক্রয় করেন ডা. মোজাম্মেল হক। মোজাম্মেল হক যাদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেছেন তাদের কোনো দলিল নেই।
আবার ডা. নুরুল ইসলামও যাদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেছেন তাদের কোনো দলিল নেই। কারণ ডা. নুরুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হক যাদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেছেন তারা সবাই পাওয়ার অ্যাটর্নির বলে মালিক ছিল। মূলত এসব জমি বিক্রেতাদের পাওয়ার অ্যাটর্নির কাগজপত্র সঠিক ছিল না।

১৯৬৩ সালে গরিমন বেওয়া তার জমি টিবি হাসপাতালের কাছে হস্তান্তন করেন। তিনি মৃত, অথচ তার জমি নিয়ে এতো কিছু হলেও তার পরিবারের কেউ এসব বিষয় কিছু জানেন না। অথচ গরিমন বেওয়ার ওয়ারিশদেরই নাম ব্যবহার করে বিক্রেতারা পাওয়ার অ্যাটর্নি নিয়েছেন, করেছেন দলিল।

গরিমন বেওয়ার পরিবারের লোকজন বলছেন, কিছু ব্যক্তিরা তাদের জানায় যে টিবি হাসপাতালের ওই জায়গা তাদের নামে আছে। যদি ওয়ারিশরা তাদের ভোটার আইডিসহ কাগজপত্র দেন তাহলে তারা নিজেরাই বিষয়টি দেখবেন। জমিটি উদ্ধার করতে পারলে বিক্রি করে তাদের অর্ধেক টাকা দেয়া হবে। এমন ভুয়া তথ্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ড নেয়া হয়। পরে কৌশলে এই সিন্ডিকেট নিজেদের মত করে পাওয়ার অ্যাটর্নি বানিয়ে নেন।

যা গরিমনের পরিবারের কেউ জানে না। তবে গরিমন বেওয়ার ওয়ারিশরা পাওয়ার অ্যাটর্নি দিয়েছেন এমন দাবি করেছেন এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য আবু ইউসুফ সেলিম। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, গরিমন বেওয়ার ওই জমির খাজনা খারিজ কারেন্ট ছিল। তার ছেলেরা ওই খাজনা খারিজ দিয়ে আসছিল। সেই জায়গা থেকে আমরা জমিটির পাওয়ার অ্যাটর্নি নিয়ে মোজাম্মেল হকের কাছে বিক্রি করেছি। এখন প্রশ্ন হলো গরিমন বেওয়ার যে ছেলেরা ১৯৬৩ সালে সরকারের কাছে জমি হস্তান্তর করার সাক্ষী, তারাই আবার ২০২০ সাল বা ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই জমির খাজনা দিয়ে আসছে ?

জানা গেছে, তিন চিকিৎসকসহ ৬জন জমি কেনার পর প্রথমে দখলে নামেন। আওয়ামী লীগ নেতা ডাবলু সরকারের নেতৃত্বে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম রুবেল, তার ভাই সেলিম জাফর, সাবেক রাসিক মেয়রের পিএস আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু, লটন, ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুজ্জামান টুকু, ওই ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুদ রানা বাবু, আবু ইউসুফ সেলিমসহ একটি বাহিনী এই জমি ডা. নুরুল ইসলাম ও ডা. মোজাম্মেল হকসহ ক্রেতাদের দখল নিয়ে দেয়।

জমি দখল নেয়ার পর শুরু হয় জাল জালিয়াতির সব কাজ। একদিকে জমির খারিজ খাজনার জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়ে বোয়ালিয়া ভুমি অফিসে তৎবির, অন্য দিকে রাজশাহীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্লান পাস করার চেষ্টা। যদিও ডা. নুরুল ইসলাম, ডা. মোজাম্মেল হক, ডাক্তার শফিউল্লাহকে আরডিএ’র প্লান পাস, ভুমি অফিসে জমির খারিজ খাজনা নিজেদের নামে করার ব্যাপারে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারণ, তাদের মাথার উপর যে হাতটি ছিল সেটি সাবেক মেয়র লিটন ও ডাবলু সরকারের। এই দুই আর্শিবাদ বাবার সুবাদে ভুমি অফিসে জমির খারিজ খাজনা, আরডিএ থেকে প্লান পাসসহ সব কিছু হয়েছে রকেটের গতিতে। আর টিবি হাসপাতালের পক্ষে জমির খারিজ খাজনা বাতিলের আবেদন করলে সেটি চলে কচ্চপের গতিতে।

টিবি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সরকার এই জায়গা অধিগ্রহণ করেছে, কিন্তু সেই সরকারী জায়গা নিয়ে চলছে দখলবাজি। তারা বিষয়টি জানার পর বোয়ালিয়া ভুমি অফিসে খারিজ খাজনা বাতিলের আবেদন করেন। একই সাথে তারা যেনো সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে না পারে সে বিষয়টিও আরডিএ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। টিবি কর্তৃপক্ষ সরকারী জমি রক্ষায় কাজ করলেও খোদ সরকারের লোকজনই তাদের সাথে বিদ্রুপ করে বসে।

জানা গেছে, তৎকালীন বোয়ালিয়া ভুমি অফিসের এ্যাসিল্যান্ড শাহিন আলম টিবি হাসপাতালের জমি দখলের বিষয়ে নিজেও জড়িত ছিলেন। জড়িত দিলেন নাজির আহমেদ নামে অপর এক ব্যক্তি। তারা দুজন ডাক্তারদের কাছে মোটা অংকের টাকা পেয়ে জমির সব জালজালিয়াতি করে দেয়। যার কারণে ডাক্তাররা দ্রুত গতিতে তুলতে থাকে ভবন। টিবি হাসপাতালের পক্ষে যারা সরকারী জমি রক্ষার জন্য ভুমি অফিসে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন এ্যাসিল্যান্ড জেনে বুঝে টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লম্বা তারিখ দেন শুনানির। যেনো এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসকরা দ্রুত ভবন নির্মাণ শেষ করতে পারেন।

বিষয়টি টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে আদালত ভবন নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে চিকিৎসকরা আদালতের নিষেধাজ্ঞা স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে আবারো কাজ শুরু করেন। চিকিৎসকদের পক্ষে ভুমি অফিস ও আদালতে দৌড়ঝাঁপ করেন, ডা. নুরুল ইসলামের পিএ ও ডাক্তার মোজাম্মেল হক। জাল জালিয়াতির জন্য এই দুইজন পারাদর্শী ছিলেন বলে তাদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়।

টিবি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, টিবি হাসপাতালের জমি রক্ষার জন্য প্রধান সহকারী শফিকুল ইসলাম আদালত ও ভুমি অফিসে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন। গত ১৬ মে ডা. মোজ্জাম্মেল হক, ডা. নুরুল ইসলাম লোকজন নিয়ে টিবি হাসপাতালে যান। সেখানে শফিকুল ইসলামকে হুমকি দিয়ে বলেন, আপনাকে গায়েব করে দিতে কতটুকু সময় লাগবে। এব্যাপারে টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেন। এছাড়াও ডা. শফিউল্লাহ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, যে জমির উপর তার চোখ পড়ে সেটি সরকারী বা বেসরকারী যাই হোক সেটি তার। মূলত তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা বলে এমন দাপট দেখিয়ে আসছে।

এদিকে ওই জমির আরো একজন দাবিদার বের হয়েছে। নগরীর ভাটাপাড়া এলাকার আবু বাক্কারের ছেলে মাফিজুল ইসলাম তার বাবার দলিল মূলে এই জমি দাবি করেছেন। তিনি বলছেন, ৪০৫ দাগে ৯একর জমির অংশিদার তিনি ও তার বোন। তার বাবা জমিটি ১৯৯২ সালে ক্রয় করেছেন আমিন শেখের ছেলে খোদাবক্স, আলাবক্স, আলাউদ্দিনসহ কয়েকজনের কাছ থেকে। এমনকি গরিমন বেওয়া ওই জমি একাব্বর আলীর কাছ থেকে কেনার সময় দিক উল্লেখ করে দিয়েছেন। সেখানে দক্ষিনে আমিন শেখের জমি রয়েছে। যদি ২৫শতক জমি টিবির হয় তাহলে দলিলে উল্লেখ করা দক্ষিন পাশের ৯ শতক জমি কোথায় এমন প্রশ্ন তুলেছেন মাফিজুল ইসলাম মুন্না।

এব্যাপারে টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আমিন শেখ গরিমন বেওয়ার ছেলে। গরিমন বেওয়ার জমি সরকারের কাছে হস্তান্তর করলে তার নাতিপুতি বা ছেলেরা কি করে পান। তার নাতিপুতিরাই বা কোন ওয়ারিশ সূত্রে ওই জমি বিক্রি করতে পারেন। আবু বাক্কার ৯ শতক জমি ক্রয় সূত্রে দাবি করলে টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা করেন। পরে আদালত টিবির পক্ষে রায় দেন। বর্তমান খারিজ খাজনা টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন বলে জানান সুপারিন্টেনডেন্ট ডা. মজিবুর রহমান।

সর্বশেষ - রাজশাহীর খবর