রাজশাহী চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী পেলিকানের ৩০ বছরের নিঃসঙ্গতা

আমজাদ হোসেন শিমুল:

বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্দি পরিযায়ী পাখি পেলিকান। সেখানে ৩০ বছর ধরে বন্দি অবস্থায় নি:সঙ্গ জীবন-যাপন করায় এখন অনেকটা খাওয়া-দাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে এটি। পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুটা উন্মুক্ত স্থানে চিকিৎসা-সেবা দিয়ে অনেকটা সুস্থ হওয়ার উন্মুক্ত স্থানে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। অথবা পাখিটির শেষ বয়সে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এটির জন্য একটি মা পাখির ব্যবস্থা করে তার ৩০ বছরের নি:সঙ্গতা কাটানোর ব্যবস্থা করতে পারেন।

গতকাল শুক্রবার রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ৩০ বছর ধরে এটি নি:সঙ্গ জীবন-যাপন করায় খাঁচার মধ্যেই অনেকটা চুপষে গেছে এটি। নেই কোন নড়াচড়া। অনেকটা মূর্তির মতই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে তার নি:সঙ্গ কষ্টের সময় অতিবাহিত করছে।

চিড়িযাখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের শীতকালে নওগাঁর একটি বিল থেকে এটি উদ্ধার করা হয়। ওই দিন শিকারিরা দুটি পেলিকান পাখির খোঁজ পায়। তৎক্ষণাৎ পাখি দুটি লক্ষ করে গুলি ছোড়ে প্রকৃতি বিমুখ ওই শিকারির দল। এতে স্ত্রী পেলিকানের শরীরে গুলি লাগে। আর আরেকটি শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে। গুলিতে আহত স্ত্রী পেলিকানকে মূহুর্তের মধ্যেই শিকারিরা নি:শেষ করে দেয়। তবে ওই এলাকার পাখি প্রেমী কিছু মানুষ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহায়তায় পুরুষ পেলিকানটিকে শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিেেজদের হেফাজতে নেয়।

পরে এটিবেক রাজশাহী চিড়িয়াখানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে রাজশাহী চিড়িয়াখানার খাঁচায় গত তিন দশক থেকে নি:সঙ্গ বন্দি জীবন অতিবাহিত করছে পাখিটি। তখন থেকেই নিয়মিত মুখ বিহঙ্গে ডানা মেলে উড্ডীয়ন বন্ধ হয়ে খাঁচায় বন্দি জীবন শুরু হয়।

পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেলিকান সাধারণত ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত আয়ুষ্কাল থাকে। তবে রাজশাহী চিড়িয়াখানায় নি:সঙ্গ জীবন অতিবাহিত করা গ্রেট হোয়াইট জাতের এই পেলিকানটির আনুমানিক বয়স ৩৬ থেকে ৩৭ বছর। হয়তো এটির আয়ু আর খুব বেশি দিন নেই। যেকোনো সময় নি:সঙ্গ জীবন-যাপন করতে করতেই চিরবিদায় নিতে পারে।

চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে একবার এই পেলিকানটি মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর খাঁচায় বন্দি থাকায় পাখিটি আর আগের মতো উড়তে পারেনি। অল্প একটু দূরে যেতে চিড়িয়াখানার পাশের একটি রাস্তায় পড়ে যায়। পরে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাকে আবার নিয়ে আসে। পাখিটি লোকালয়ে পড়লে মানুষ ক্ষতি করতে পারে, তাই আর পাখিটিকে ছাড়ার উদ্যোগ নেয়নি তাঁরা।

তবে রাজশাহীর পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য হাসনাত রনী বলেন, ‘এই পাখিটির ইংরেজি নাম পেলিকান। এর বাংলা নামও আছে। আর তা হলো গগনবেড়। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম পেলিকানাস কমসপিসিলাটাস। শীতকালে দেশে যেসব অতিথি পাখি আসে ও দেশে যত পাখি রয়েছে, তার মধ্যে পেলিকান আকারে সবচেয়ে বড়। পেলিকান বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তবে রাজশাহী চিড়িয়াখানায় বন্দি পাখিটি গ্রেট হোয়াইট পেলিকান জাতের।

তিনি আরও বলেন ‘মুক্ত বিহঙ্গে উড্ডীয়ন কোনো পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখার মত অমানবিক কাজ আর হতে পারে না। কেননা, ছোট বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্য একটি মুক্ত পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত তা আমার বোধগম্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে পাখিটি খাঁচায় বন্দি অবস্থায় হঠাৎ করে অবমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি খাঁচায় বন্দি রেখে হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলে কীভাবে ওই পাখিটি উড়ে চলে পারে। যদি সত্যিকার অর্থেই এটিকে অবমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে গাজীপুুরের সাফারি পার্কের উন্মুক্ত স্থানে কিছুদিন রেখে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তারপর অবমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’

এই পাখি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘বিভিন্ন জাতের পেলিকান পাখি রয়েছে। রাজশাহী চিড়িয়াখানায় বন্দি পাখিটি গ্রেট হোয়াইট পেলিকান জাতের। এছাড়া আমেরিকান হোয়াইট পেলিকানসহ বিভিন্ন প্রজাতির পেলিকান রয়েছে। তবে দিন দিন পেলিকান প্রজাতির পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই পাখি খুব কমই চোখে পড়ে। আমি ২০১৭ রাজশাহীর পদ্মার চড়ে গ্রেট হোয়াইট পেলিকান জাতের একটি পাখির দেখা পেয়েছিলাম।’

পাখিটির নিসঙ্গতা কাটানোর বিষয়ে এই পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমি কখনোই কোনো পাখিকে খাঁচায় বন্দি রেখে শিশুদের আনন্দ দেয়ার পক্ষে নই। তার মানে হলো, পাখিটির নি:সঙ্গতা কাটানোর জন্য আরেকটি পাখি তার সঙ্গে বন্দি খাঁচায় রেখে পাখিটির মুক্ত বিহঙ্গে ডানা মেলার স্বাধীনতা হনন করা উচিত বলে আমি মনে করি না।’

তবে চিড়িয়াখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ভেটেরিনারি কর্মকর্তা মো. ফরহাদ উদ্দিনের সঙ্গে পাখিটির নি:সঙ্গতা কাটানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘পাখিটিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও যখন যেতে পারল না, তখন একটি সদেওয়ার জন্য ঢাকা চিড়িয়াখানা ও কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে যোগাযোগ করি। কিন্তু কোনো স্ত্রী পেলিকান আমরা খুঁজে পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, পাখিটির বয়স হয়েছে। মাঝে দুই-তিনবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সেবা-শুশ্রুষার করে এখন বর্তমানে স্স্থু রয়েছে।

পেলিকান পাখিটিকে চিড়িয়াখানায় করেন বাবর আলী নামের এক ব্যক্তি। চিড়িয়াখানার এই প্রধান পশু পরিচর্যাকারী বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৯টা-১০টায় পাখিটিকে মাছ খেতে দেওয়া হয়। খাবার দিতে গেলে পাখিটি কাছে আসে। ওর কোনো অসুবিধা হলে বুঝতে পারি। তবে বয়স হয়ে যাওয়ায় ওর শরীরের অবস্থা এখন খুব একটা ভালো নয়।’

পাখিবিশারদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ পেলিকান পাখি ৪০-৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। রাজশাহী চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্দি পাখিটির বয়স আমার ধারনা ৩৭-৩৮ বছর হয়ে গেছে। তার মানে হচ্ছে এটির আয়ু শেষের দিকে। সাধারণত খাঁচায় বন্দি রাখার কারণে এটি অইেশ আগেই মারা যাওয়ার কথা। তারপর আবার তিন দশক ধরে নি:সঙ্গ জীবন-যাপন করছে। যেহেতু এখনো বেঁচে আছে তাই এটির নি:সঙ্গতা কাটাতে দেশের যদি কোথাও স্ত্রী পেলিকন পাওয়া যায় সেটি নিয়ে সেখানে রাখা যেতে পারে। অথবা দেশে পাওয়া না গেলে ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশ থেকে একটি স্ত্রী পেলিকান নিয়ে আসা যেতে পারে। এই ব্যবস্থা করতে পারলে বিলুপ্ত প্রায় পেলিকান পাখির বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে।’

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনসহ সারা হাওর-বাঁওড়ে নিয়মিত আসত এই পেলিকান পাখি। আশির দশকে সিলেট এলাকায় বেশ মারা পড়ত। দেশে যেসব পরিযায়ী পাখি আসে ও আছে তার মধ্যে পেলিকান সবচেয়ে বড়।এরা ছোট ছোট দলে থাকে। পেলিকান সত্তরের দশক পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই পাওয়া যেত। তারপর থেকে কমতে থাকে। এটা বরাবরই বিরল পরিযায়ী পাখি।

এএইচ/এস