রাজশাহীর হোটেলগুলোতে ফুটপাতেই তৈরী হচ্ছে অধিকাংশ খাবার, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিভাগীয় শহর রাজশাহী শিক্ষা ও রেশম নগরী নামে পরিচিত। অনেকে রাজশাহীর পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে এর নাম দেন ক্লিন সিটি। রাজশাহীর এই সুনাম অর্জনের প্রশংসার দাবিদার খোদ এখানকার মানুষ। দিনে দিনে সভ্যতা বাড়তে থাকায় রাজশাহীতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন খাবারের দোকান, হোটেল এবং ফাষ্টফুডের দোকান। যেখানে রুচিশীল খাবারপ্রিয় গ্রাহকেরা স্ববান্ধবে গিয়ে রসনার স্বাদ উপভোগ করেন।

অনেকে রাজশাহীর বাইরে থেকে এসে এখানকার সেরা খাবার হোটেলটি খুঁজে বের করেন। খোঁজেন স্বাস্থ্যসম্মত এবং সুস্বাদু খাবার। কিন্তু গ্রাহকদের কাছে কেমন খাবার সরবরাহ করছেন এখানকার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিকরা? আদৌ কি সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত, নাকি তা খাবারের অযোগ্য-এমন প্রশ্ন এখন বড় আকার ধারণ করেছে জনমনে।

রাজশাহীর হোটেল, রেস্তোরাগুলোতে খাবার দোকানগুলোতে সরবরাহ করা খাবার নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সিল্কসিটি নিউজের কাছে যা ধরা পড়ে-তা দেখে চোখ যেন চড়কে উঠার মতো অবস্থা। অধিকাংশ হোটেলগুলোতে খাবার তৈরী হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে। এমনকি হাতে গোনা দুই-একটি হোটেল ছাড়া ছাড়া বাকি সব হোটেল রেস্তোরার খাবারই তৈরী হয় রাস্তার ফুটাপাতে। যেসব খাবারে ধুলাবালি পড়ে সবসময়ের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে করে মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছে নানা রোগ-বালাই।

তারপরেও থেমে নেই হোটেলগুলোতে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরীসহ পরিবেশনের কার্যক্রম।  রাজশাহীর খাবার হোটেল ও রেস্তোরাগুলো নিয়ে থাকছে সিল্কসিটির বিশেষ আয়োজন।

শনিবার সরেজমিন নগরীর লক্ষীপুর এলাকার তৃপ্তি হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলেন ঘোষপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইমতিয়াজ আলী। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের খাবার পরিবেশন দেখে জানালেন তার অনুভুতি।

ইমতিয়াজ বলেছিলেন, লক্ষীপুর মোড়ের এই হোটেলটি এখন শুধু নামেই চলছে। বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের হাজারো রোগীর স্বজনেরা এখান থেকে খাবার কিনে নিয়ে যান বা বসে বসেই উদর ভরে নেন। কিন্তু এখন এখানকার খাবার মান অত্যাধিক নিন্মমানের হয়ে গেছে।

খাবারের দাম যা নিচ্ছে তার তুলনায় খাবারের মান অনেক কমে গেছে। খাবার যেখান থেকে সরবরাহ করা হয়, সেখানকার পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। এক্ষেত্রে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর কথা জানান তিনি।

এর আগে এই হোটেলটিতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে প্রায় দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু তার পরেও এই হোটেলের খাবার মাণ উন্নত করা হয়নি। বরং দিনের পর দিন এখানে খাবারের মান নিম্নমুখি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শনিবার দুপুরে খেতে আসা ভোক্তা হযরত আলী, সোলেমান আলীসহ আরো অনেকেই।

  • হোটেলটিতে পুরি, সিঙ্গাড়া এবং মুখরোচক খাবারগুলো তৈরী হয় ফুটপাতে। যেখানে রাস্তার ধুলাবালি সঙ্গী হচ্ছে এসব খাবারে।

এই হোটেলটিতে ভোক্তাদের খাবার পানি সরবরাহও করা হয় সিটি করপোরেশন থেকে পাইপ লাইনে সরবরাহকৃত অস্বাস্থ্যকর পানি। যা পানের অযোগ্য। বিশুদ্ধ পানির নামে ফিল্টার পানি সরবরাহ করা হলেও তার মাণ নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

তবে নিম্নমাণের খাবার পরিবেশনের কথা অস্বীকার করে হোটেল মালিক আসলাম সরকার। তিনি বলেন, আমরা সবসময় ভালমাণের খাবার সরবরাহের চেষ্টা করি। গ্রাহকরাও খেয়ে মজা পান।

  • একই অবস্থা তৃপ্তি হোটেলের পাশের হোটেলটিতেও। এখানেও নিম্নমাণের খাবারে সয়লাব। ভিতরের পরিবেশও নোংরা থাকে সবসময়। এ হোটেলে খেতে আসা আফসার উদ্দিন বলছিলেন, উপায় নাই, রাজশাহীর সব হোটেলই একই দশা। যেখানেই যাবেন, সবটাই নোংরা এবং নিম্নমাণের খাবারে ভর্তি। ফলে বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

নগরীর সাহবে বাজার জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন বিদ্যুৎ হোটেলেরও। খাবার তৈরী থেকে শুরু করে পারিবেশন সবটাই অস্বাস্থ্যকর। গ্রাহকদের দাবি প্রতিবছর এখানে খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু সে তুলনায় খাবারের মাণ কমে গেছে।

তানজিমুল ইসলাম নামে রাজশাহী কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, আগে এখানে শহরের সবচেয়ে ভালো সিঙ্গাড়া তৈরী করা হতো। শহরের বা এর বাইরের অসংখ্য ক্রেতা এখানে আসতো। এখন সিঙ্গাড়ার মাণ অনেক খারাপ। আবার অন্যান্য খাবারও পরিবেশন করা নিম্নমাণের।

  • নগরীর হোটেল জোনাকি এবং ঐতিহ্যবাহী রহমানিয়া হোটেলের খাবারের মাণও ব্যাপক হারে নিম্নমুখি হয়েছে বলে দাবি করে এ দুটি হোটেলে খেতে আসা ভোক্তারা। শনিবার রাতে কথা হয়, এমন কয়েকজন ভোক্তাদের সঙ্গে। তাদের দাবি, আগের রহমানিয়া আর জোনাকি হোটেল এখন আর নাই। এখন খাবার প্রায় সবগুলো নিম্নমাণের। এ দুটি হোটেলে রুটি এবং পরাটা তৈরী হয় রাস্তার ধারে ফুটপাতে। এতে করে এসব খাবার সবসময় স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক বলে মনে করছেন ক্রেতারা।

রহমানিয়ার বিখ্যাত গরুভুনাও এখন আর টানছে তেমন না ক্রেতাদের। তারপরেও ক্রেতারা কেবল নামেই ছুটছেন ওখানে। আবার মাণসম্মত তেমন হোটেল গড়ে না উঠায় বাধ্য হয়েও যেতে হচ্ছে এসব হোটেলে।

নগরীর বিন্দু হোটেলের পরিবেশ কিছুটা উন্নত হলেও এখানে খাবারের দাম আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা। সেই অনুপাতে খাবারের মাণ ভাল নয় বলেও দাবি করেন ক্রেতারা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে হোটেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘আমাদের পরিবেশ এবং খাবারের মাণ অনুযায়ী দাম ঠিক আছে।’

এর বাইরে অলি-গলির হোটেলগুলোতে তো খাবারের মাণ নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এসব হোটেলগুলোতে ভোক্তাদের মালিকরা কি খাওয়াচ্ছেন-তা নিয়েই রয়েছে সন্দিহান। নামি-দামি হোটেলগুলোর চেয়ে এসব হোটেলে খাবার শস্তায় পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু পরিবেশন থেকে শুরু করে খাবার তৈরীর স্থানগুলোর দুর্দশা দেখে যে কারো রুচি নষ্ট হয়ে যায়। এসব হোটেগুলোতে অভিযানও হয় না সহজে।

গতকাল নগরীর উপশহরের নিউমার্কেট এলাকার হোটেলে খেতে আসা আজিবুর রহমান নামের একজন ভোক্তা বলছিলেন, ‘খাবারের প্লেটগুলোর দিকেও তাকানো যায় না। ফলে চো-মুখ বুজে কোনো মতে খেয়ে টেবিল ছাড়তে বাধ্য হয়। এতো বড় শহরে ভালোমানের হোটেল গড়ে উঠলো না আজো। ফলে এসব হোটেলেই খেতে হচ্ছে ভোক্তাদের।’

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা নগরীর বাস্ট্যান্ডের হোটেলগুলোতে। এখানে খাবারের মান একেবারে নিম্নমাণের বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে। খাবার তৈরী থেকে শুরু করে পরিবেশন এমনকি খাবার রাখাও হয় ধুলা-বালি পড়ে এমন স্থানে। একই অবস্থা নগরীর ফুটপাতের ধারে গড়ে ছোট-ছোট হোটেল ও রেস্তোরাগুলোতেও।

গাড়ী, বাতাসে উড়ে আসা এবং মানুষের পায়ের ধুলা-বালিতের সয়লাব হয়ে থাকে এসব হোটেলের খাবারগুলো। এমনকি খাবার তৈরীও করা হয় ফুটপাতের ধারে বা ফুটপাতের ওপরে। ফলে এসব খাবার যেমন হয় নোংরা তেমন অস্বাস্থ্যকর।

ভালোমানের কয়েকটি দুই-একটি হোটেল রাজশাহীতে গড়ে উঠলেও এসব হোটেলে দাম আদায় করা হচ্ছে গলা কাটা। এর মধ্যে রয়েছে নগরীর লক্ষীপু এলাকার মাস্টার সেফ বাংলা এবং অলোকার মোড় এলাকার রহমানিয়া প্লাস হোটেল। এই হোটেল দুটি দেশিয় খাবার পাওয়া যায়। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ রাজশাহীর তুলনায় দুটি হোটেলে খাবারের দাম অনেক বেশি।অলোকার মোড়ের রহমানিয়া প্লাসে নান রুটি ও গ্রিল তৈরী হয় রাস্তার ধারে ফুটপাতে।

খাবার নোংরার কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা: আ ন ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘অধিকাংশ রোগ-বালাই হয় মানুষ অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের কারণে। সেই হিসেবে রাজশাহীর হোটেল-রেস্তোরাগুলো অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের মাত্রা খুবই বেশি। বলা যায়, এটি মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে করে ক্রমেই মানুষের রোগ-বালাইয়ের হার বাড়ছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়ছেন মানুষ।’

স/আর