রাজশাহীর গৌরব : কান্তকবি রজনীকান্ত সেন

বাংলা কবিতা ও গানের পাঁচ মহারথি। যেন বাংলার আকাশে পাঁচ দীপ্তিমান সূর্য। ‘পঞ্চকবি’ নামেই তাঁরা খ্যাত। সকলের বড় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। সকলের ছোট কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। মাঝে তিন-কবিরত্ন—‘ডি এল রায়’ নামে খ্যাত দ্বীজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)।

বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় রজনীকান্ত তাঁর সুবিখ্যাত গান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ রচনা করেন। তাঁর এই গান তৎকালীন স্বদেশী আন্দোলনে ব্যাপক অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেছিল।

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়…অমর এই গান সৃষ্টির ইতিহাস-বিবরণে জানা যায় যে, ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউন হলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, এখন হতে বিলেতি পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য গ্রহণ করা হবে।  ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষত: আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরি বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতের তৈরি কাপড়ের তুলনায় মান কম। এক শ্রেণির ভারতবাসি বিলেতের কাপড়ের পক্ষেই থাকে। এই কিছুসংখ্যক ভারতীয়দেরকে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত দেশাত্মবোধক ও অবিস্মরণীয় গানটি। এই একটি গান রচনার ফলে রাজশাহীর পল্লী-কবি রজনীকান্ত সমগ্র বঙ্গের জাতীয় কবির মর্যাদায় সিক্ত হন। স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত মহাত্মাগান্ধীসহ নেতৃবর্গ গানটিকে উপজীব্য করে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপণায় অগ্রসর হতে থাকেন। ভারতীয় বিপ্লবী নেতারাও পরবর্তী বছরগুলোয় বেশ সোৎসাহে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গানটিকে ঘিরে।

কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের রাজশাহীর ঐতিহাসিক প্রাচীন এই বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের সম্পত্তি এখন। ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গৌরবের এই বাড়িটি কয়েক বছর আগে সোনালী ব্যাংক ভেঙ্গে ফেলেছে । বাড়িটি রক্ষায় তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি। ছবি : সংগৃহীত

পরবর্তীকালে তিনি প্রায় একই ঘরানার আরও একটি জনপ্রিয় গান রচনা করেন-‘আমরা নেহাত গরীব, আমরা নেহাত ছোট, /তবু আছি সাতকোটি ভাই,-জেগে ওঠ!’

রজনীকান্তের বিখ্যাত প্রার্থনাসঙ্গীত দুই বাংলায় বেশ জনপ্রিয়-: ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে; /তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে…।

রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালী পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার বেলকুচি থানার ভাঙাবাড়ী গ্রামে বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রীযুক্ত গুরু প্রসাদ সেন ও মাতা শ্রীমতী মনোমহিনী দেবীর তৃতীয় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত। শ্রী গুরু প্রসাদ সেন ছিলেন সাবজজ, লেখক ও সুগায়ক। কবির পিতার বড় ভাই শ্রীযুক্ত গোবিন্দনাথ সেন ছিলেন রাজশাহীর বিখ্যাত উকিল, ধনবান ও দানশীল ব্যক্তি। রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। কিশোর বয়সেই রজনীকান্ত মায়ের সাহিত্যপ্রীতিতে চেতনাদীপ্ত হন।

নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজ-সন্তান কুমার শরৎকুমার রায়কে লেখা কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের নিজ হাতে লেখা পত্র। ছবি : সংগৃহীত

রজনীকান্ত সেনের বাল্যশিক্ষা সূচনা রাজশাহীর বোয়ালিয়া জেলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল)। এরপর, ১৮৮২ সালে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, রাজশাহী কলেজ থেকে ১৮৮৫ এফএ (ফাষ্ট আর্টস বা উচ্চ মাধ্যমিক), ১৮৮৯ সালে কলিকাতা সিটি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৮৯১ সালে একই কলেজ থেকে বিএল পাস করে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন এবং রাজশাহীতেই নিবাস গড়েন। রজনীকান্ত সেন কিছুদিন তিনি নাটোর এবং নওগাঁ জেলায়ও অস্থায়ীভাবে মুন্সেফ হিসেবে কাজ করেছিলেন।

সংগীত রচনা আর সাহিত্যসেবায় রজনীকান্ত সেন নিমগ্ন থাকতেন। তাই ওকালতিতে খ্যাতি আসেনি। কালীসঙ্গীত রচনার মাধ্যমে রজনীকান্ত অপূর্ব কবিত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটান, তখন তাঁর বয়স মাত্র পনের। রজনীকান্তের বন্ধু নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদারপুত্র কুমার শরৎকুমার রায়কে লিখিত পত্রে তিনি বলেন, ‘কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল।’

রজনীকান্তের গান ‘কান্তগীতি’ নামে পরিচিত। কান্তকবির কবিতা ও গানের ভাষা সহজ-সরল, কিন্তু গভীর দেশপ্রেমে প্রাণিত। তাঁর ভক্তিগীতি স্রষ্টার প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি করে। পণ্ডিতগণ রজনীকান্তের রচিত গান-কবিতাকে চার ভাগে করে থাকেন -দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান এবং হাস্যরসের গান। রাজশাহীর যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে রজনীকান্তের গান গাওয়া হতো।

রজনীকান্তের গান ‘কান্তগীতি’ নামে পরিচিত। কান্তকবির কবিতা ও গানের ভাষা সহজ-সরল, কিন্তু গভীর দেশপ্রেমে প্রাণিত। তাঁর ভক্তিগীতি স্রষ্টার প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি করে। পণ্ডিতগণ রজনীকান্তের রচিত গান-কবিতাকে চার ভাগে করে থাকেন -দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান এবং হাস্যরসের গান। রাজশাহীর যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে রজনীকান্তের গান গাওয়া হতো।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রজনীকান্তের ছিল নিবিড় সখ্যতা ও বন্ধুত্ব। মূলত সে-সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রাজশাহী জেলা জজ কবিগুরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিত, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়, কান্তকবি রজনীকান্ত সেন, নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদারপুত্র কুমার শরৎকুমার রায়, ইতিহাসবিদ রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখকে ঘিরে রাজশাহীতে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল।

রজনীকান্ত ১৮৮৩ সালে কবি-প্রতিভাময়ী হিরন্ময়ী দেবীকে বিবাহ করেন। তাঁদের পাঁচ পুত্র – শচীন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র, ভুপেন্দ্র, ক্ষিতীন্দ্র ও শৈলেন্দ্র এবং চার কন্যা – শতদলবাসিনী, শান্তিবালা, প্রীতিলতা ও তৃপ্তিবালা। কিন্তু পুত্র ভুপেন্দ্র ও কন্যা শতদলবাসিনী খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা রেখে পরদিনই রচনা করেন –

তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,

তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷

তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,

তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷

রজনীকান্তের উল্লেখযোগ্য রচনা : বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫), অমৃত (১৯১০), অভয়া (১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), শেষদান (১৯১৬)। ‘বাণী’ ও ‘কল্যাণী’ গ্রন্থ দু’টি গানের সংকলন। রাজশাহী থেকে প্রচারিত মাসিক ‘উৎসাহ’ পত্রিকায় রজনীকান্তের রচনা প্রকাশ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

কান্তকবি রজনীকান্তের শেষ দিনগুলো ছিল অতি কষ্টের। ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হন। প্রকট আর্থিক সঙ্কট। মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী ও কুমার শরৎকুমার রায় আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন।

১৯০৯ সালে ১০ সেপ্টেম্বর কলিকাতায় চিকিৎসা নিতে যান। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করান। কিছুটা আরোগ্য লাভ করলেও চিরতরে বাকশক্তি হারান। এ সময় কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা তাঁর দেখাশোনা ও খোঁজ-খবর নিতেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, ১৯১০ সালের ১১ জুনে। কিন্তু ডাক্তারদের শত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় । মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর কলিকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলার অমর সন্তান কান্তকবি রজনীকান্ত সেন চির বিদায় নেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, ১৯১০ সালের ১১ জুনে। কিন্তু ডাক্তারদের শত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় । মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর কলিকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলার অমর সন্তান কান্তকবি রজনীকান্ত সেন চির বিদায় নেন।

রাজশাহী শহরের সাহেব বাজার বড় মসজিদের পেছনে বহু কক্ষবিশিষ্ট একতলা দালানটি ছিল কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের বাড়ি। বাড়ির নাম ‘আনন্দ নিকেতন’। বেশ মজবুত ছিল দালানটি। কবি নজরুল ইসলাম ১৯২৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরে রাজশাহী আসেন, ‘দি রাজশাহী মুসলিম ক্লাব’-এর আমন্ত্রণে। রাজশাহীতে অবস্থানের তৃতীয় দিন প্রত্যুষে কবির অভিলাষ অনুসারে কান্তকবির বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। কবি নজরুল পরম মমত্বে কান্তকবির বাড়ির এ-কক্ষ ও-কক্ষে যান, ঘুরে ঘুরে দেখেন, আবেগতাড়িত হন।

কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের রাজশাহীর ঐতিহাসিক প্রাচীন এই বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের সম্পত্তি এখন। ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গৌরবের এই বাড়িটি কয়েক বছর আগে সোনালী ব্যাংক ভেঙ্গে ফেলেছে । বাড়িটি রক্ষায় তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি।

কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের রাজশাহীর ঐতিহাসিক প্রাচীন এই বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের সম্পত্তি এখন। ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গৌরবের এই বাড়িটি কয়েক বছর আগে সোনালী ব্যাংক ভেঙ্গে ফেলেছে । বাড়িটি রক্ষায় তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি।

সমগ্র বাংলাজুড়ে ‘পঞ্চকবি’র খ্যাতি মাত্র পাঁচজন বাঙালির, এদের একজন রাজশাহীর কবি, ‘কান্তকবি রজনীকান্ত সেন’। অথচ রাজশাহী মানুষ তাঁর বাড়িটি রক্ষা করলো না! এ যেন এক পাপ! রাজশাহীর মাটিতে আর কবে জন্মাবে এমন মানুষ।

মো. সফিকুল ইসলাম : উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।