রাজশাহীর খেজুর গুড়ে মিশছে চিনি, প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মঙ্গলবার সকাল নয়টা। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বাঁশপুকরিয়া গ্রামের একটি বাড়ির উঠানে তখন তৈরী হচ্ছিল খেজুর গুড়। চুলার ওপর খেজুর রস জাল করে করে লাল আকার ধারণ করার পর যখন গুড়ে পরিনত হচ্ছিল, ঠিক তখনি ঢালা হলো কেজি পাঁচেক চিনি। এর পর ওই গুড়ের সঙ্গে চিনিগুলো মিশিয়ে দেওয়া হলো। তারপর চিনিগুলোও মিশে গিয়ে গুড়ে পরিণত হলো। ফলে গুড় চিনি মিশে এক হয়ে ভেজাল খেজুর গুড়ে পরিণত হলো।

শুধু পুঠিয়ার ওই বাড়িতেই নয়, এভাবে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজশাহীর পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা, চারঘাট, বাগমারায় এভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার কেজি খেজুর গুড় উৎপাদন হচ্ছে চিনি মিশিয়ে। এতে করে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাজারে চিনির দামের চেয়ে খেজুর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় গত অন্তত ৫-৭ বছর ধরে এই প্রক্রিয়ায় খেজুর গুড় উৎপাদন করছেন চাষিরা। এতে করে রাজশাহীর বাজারে যেসব রেখজুর গুড় এখন পাওয়া যাচ্ছে-তার ৯৯ ভাগই চিনি মেশানো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে গুড়ে পরিণত করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি নাই। কিন্তু ভোক্তারা যেহেতু প্রতারিত হচ্ছে, সে কারণে এই উপায়ে খেজুর গুড় উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করছেন তাঁরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শীত যত বেশি হয়, খেজুর গাছ থেে রস তত বেশি হয়। এবার শীতের পরিমাণ শুরু থেকেই অনেক কম। ফলে খেজুর গাছ থেকে রসের পরিমাণও কম হচ্ছে। আবার আগের মতো ঝোঁপ-ঝাড় না থাকায় খেজুর গাছও কমে গেছে অনেক হারে। ঝোঁপ-ঝাড়ের সঙ্গে ব্যাপক হারে রাজশাহীতে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে রসের পরিমাণ কমেছে অনেক। কিন্তু বাজারে গুড়ের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো খেজুর রসের সঙ্গে চিনি মেশানো। রস জাল করে গুড়ে পরিণত হওয়ার সময় তার ভিতরে চিনি ঢেলে দিয়ে চিনিকেও গুড়ে পরিণত করা হচ্ছে। এতে করে রসের পরিমাণ কমে গেলেও গুড়ের পরিমাণ না কমে বরং বাড়ছে। আর চিনি মেশানো সেই গড়ই বাজারে বিক্রি হচ্ছে এখন বেশি হারে। এতে করে ভোক্তারা হচ্ছে প্রতারিত।

রাজশাহীর দুর্গাপুরের মাড়িয়া গ্রামের কৃষক আকবর বলছিলেন, ‘খেজুর রস গাছ থেকে সংগ্রহ করে এক কেজি গুড়ে পরিণত করতে যে পরিমাণ খরচ এখন হচ্ছে-তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হলো জ্বালানীর দাম বেড়ে যাওয়া। আর এ কারণেই অধিকাংশই কৃষ করস জাল করার সময় তাতে চিনি মিশিয়ে সেগুলো খেজুর গুড়ে পরিণত করছে। এটি করছে তারা বাড়তি লাভের আশায়।’

ওই কৃষক আরও বলেন, ‘এককেজি গুড়ে অন্তত হাঁফকেজি চিনি মেশানো হচ্ছে এখন। সেই হিসেবে ১০ কেজি আসল গুড়ের সঙ্গে অন্তত ৫ কেজি চিনি মেশানো হচ্ছে। এতে করে ৫ কেজি চিনি গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করে অন্তত ৬০ টাকা বাড়তি লাভ হচ্ছে। সেই আশায় অধিকাংশ কৃষক এখন গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশাচ্ছে।’
দুর্গাপুরের আমগাছী গ্রামের কৃষক বুলবুল হোসেন জানান, ‘শতকরা এখন ৯৯ জনই খেজুর রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে গুড় করছে। এতে করে বাড়তি আয় হচ্ছে। তবে তিনি আসল গুড়ই বিক্রি হচ্ছেন। আর তার গুড় বাজারে বিক্রি হচ্ছে এটি বেশি দামেই। ফলে তিনি চিনি না মিশিয়ে আসল গুড়ই বিক্রি করছেন। অন্যদের তুলনায় লাভ কম হলেও এ অসত পথে পা বাড়াননি তিনি এমন দাবিও করেন।

তিনি আরও জানান, বাজারে এক কেজি চিনির খুচরা মূল্য ৫৪ টাকা। কিন্তু এক কেজি খেজুর গুড়ে মূল্য অন্তত ৬৫ টাকা। আবার বস্তা হিসেবে চিনি কিনলে প্রতি কেজির দাম পড়ছে বড় জোর ৫৩ টাকা। সেই হিসেবে এক কেজি চিনি গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে গুড়ে পরিণত করে বিক্রি করলে কেজিতে অন্তত ১২ টাকা করে বাড়তি আয় হচ্ছে। সেই লোভেই অধিকাংশ কৃষক খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরী করছে।

এদিকে রাজশাহীর খেজুর গুড়ের হাটের মধ্যে জেলার দুর্গাপুর বাজার অনেকটা বিখ্যাত। এই বাজারে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে। প্রতি হাটে অন্তত ৫০ টন গুড় এসে জমা হয়। এই হাটের গুড় যায় ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু অধিকাংশই গুড়েই মেশানো হচ্ছে বাজার থেকে কিনে আনা চিনি।

এ বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী মানিক হোসেন বলেন, ‘বাজারে এখন প্রায় সব গুড়েই চিনি মেশানো থাকে। এটি ক্ষতিকারক না হলেও ভোক্তারা হচ্ছেন প্রতারিত। কারণ ভোক্তারা কেঝুর গুড় মনে করেই বাজার থেকে সংগ্রহ করছেন। কিন্তু তাতে যে চিনি মেশানো থাকছে-তা তারা টের পাচ্ছেন না। ফলে গুড়ের দামে চিনি কিনতে হচ্ছে বাড়ি টাকা দিয়ে।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইশরাত জাহান বলেন, রাজশাহীর পুঠিয়া, বাঘা, চারঘাটে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। এছাড়াও জেলার দুর্গাপুর, বাগমারা ও পবা এলাকার বেশকিছু এলাকায় এ গুড় উৎপাদন হয়। এটি এ অঞ্চলের শীতকালে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। তবে কি পরিমাণ গুড় রাজশাহীতে উৎপাদন হয় এর কোনো তথ্য রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরে নাই। এমনকি চিনি মেশানোর বিষয়টিও জানা নাই বলেও দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।

এদিকে গুড়ে চিনি মেশানোর ফলে স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা হবে কিনা জানতে চাইলে রাজশাহী সিভিল সার্জন সঞ্জিত কুমার শাহা বলেন, ‘খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশালে স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা হবে না। তবে খেজুর গুড় খেজুর গুড় হিসেবেই বাজারজাত করা উচিত। গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে সেগুলোও গুড় হিসেবে বিক্রি করায় ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছে। কাজেই এই ধরনেই কাজের সঙ্গে যারা জড়িত থাকছে, তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে। তাহলে এই অসাধু প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।’

স/আর