সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
বিগত কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে অনলাইন শপিংয়ের প্রচলন তেমন ছিল না। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশে। দেশের মানুষ এখন অনলাইন শপিংয়ে কেনাকাটা করতে শুরু করেছে। তাই এদেশে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে অনলাইন শপিং। বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক অনলাইন শপ চালু হয়েছে। যেখানে মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যই পাওয়া যায়।
যেখানে বেচাকেনা করা যায় কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই। এতে বাড়িতে বসে শুধু অর্ডার দিয়েই কেনা যায় পছন্দের যেকোনো পণ্য।
ঝামেলাহীন কেনাকাটার এমন একটা অনলাইন শপের নাম ‘ঘুড়ি’। ঘুড়ি রাজশাহী থেকে পরিচালিত ফেইসবুক বেইজড একটি অনলাইন শপ। এই অনলাইন শপটি মেয়েদের জন্য হাতের কাজ করা পোশাক তার ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়। ঘুড়ি’র উদ্যোক্তা অনিমা চৌধুরী। যার পরিকল্পনায় সবসময় ছিল নিজ উদ্যোগে সমাজের জন্য ব্যতিক্রমী কিছু কাজ করার।
অনিমার ছোটবেলা থেকেই প্রবল ঝোঁক ছিল আঁকাআঁকির প্রতি। একটু বড় হবার পর বিভিন্ন ধরনের নকশার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। আঁকাআঁকি, ডিজাইন করা এমন সব সৃজনশীল কাজের প্রতি তার আগ্রহ বাল্যকাল থেকেই।
পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছু ছোটখাটো সামাজিক ইভেন্ট পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে, বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক কম। রাজশাহীতে তা আরো কম। নেই বললেই চলে। দেশের অনেক মেয়েরাই পর্যাপ্ত মেধা আর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সামাজিক বাধা-নিষেধের কারণে কোনো কাজের উদ্যোগ নিতে পারে না। এইজন্য তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেন না।
এ রকম পরিবেশ-পরিস্থিতে নিজের মেধা আর ইচ্ছাশক্তির জোরে অনিমা ভাবতে থাকেন উদোক্তা হওয়ার বিষয়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন নারীদের উৎসাহিত করার জন্য নিজ উদ্যোগে কিছু করবেন। যার মাধ্যমে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যকে স্বাবলম্বী করে তোলা যাবে।
এমন পরিকল্পনা তার মাথায় শুরু থেকেই ছিল কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। এরকম দোটানার মধ্যে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর তার হাতে মেলে অখন্ড অবসর। এই সময় কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলেন অনিমা। এক রকম ঝোঁকের মাথায় মাত্র পাঁচ মিনিটের পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠা করলেন ফেইসবুক বেইজড অনলাইন শপ ‘ঘুড়ি’। এরপর তো ইতিহাস। ধীরে ধীরে ‘ঘুড়ি’ পরিচিত হয়ে উঠে রাজশাহীসহ সারাদেশে। দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে ক্রেতার সংখ্যা। অনিমাও তার পরিকল্পনাকে আরো সুসংবদ্ধ ও বিস্তৃত করেন। বর্তমানে ফেসবুকে ঘুড়ির লাইকের সংখ্যাই ২৬ হাজার ৫৩৩। এই অনলাইন শপের মাধ্যমে কেনাকাটা করেন শত শত নারী।
‘ঘুড়ি’ সম্পর্কে উদ্যোক্তা অনিমা বলেন, কোন উদ্যোগ নেবার জন্য অনেক পরিকল্পনার চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়ায় সেই মূহুর্তে ঝুঁকি নেবার সাহসটুকু থাকার মধ্যে। প্রথমত, একটা বিষয় শুরু করলেই যে সবাই অ্যাপ্রিসিয়েট (গ্রহণ) করবে বিষয়টা এমন না। অনেকেই প্রত্যাখান করবে। গুরুত্ব দিতে চাইবে না। কিন্তু সেই সময়টুকু আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার সাথে পার করলে ফলাফল অবশ্যই ভাল কিছু হয়।
অনিমা বলেন, ঘুড়ি ছিল আমার মধ্য রাতে হঠাৎ আসা একটা আইডিয়া মাত্র। অনেকে হাতের কাজ বলতে শুধু জামালপুর আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম জানেন। কিন্ত রাজশাহীর লোকাল প্রোডাকশনের মাধ্যমেও যে সুন্দর, উন্নতমানের ভালো হাতের কাজের জামা পাওয়া যায় এটা অনেকের কাছেই অজানা। আমার প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করার পর বাবা-মায়ের খরচে আর চলবে না।
যেভাবেই হোক নিজের একটা জায়গা দাঁড় করাবো। আমাদের মত সোসাইটিতে যেখানে ছেলেমেয়েদের ভাল ভবিষ্যত বলতে শিক্ষকতা, বিসিএস ক্যাডার, ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারে না, এ রকম একটা সোসাইটিতে ঘুড়ির মত একটা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো একটা বিরাট চ্যালেঞ্জই বটে। যদিও সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার বাবা ও মায়ের যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি।
বিশেষত আমার মায়ের। মায়ের বিভিন্ন ডিজাইনের হাতের কাজ ও সেলাইয়ের প্রতি আগ্রহ আমাকে ঘুড়ির জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছে। বাবার আগ্রহ আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণার। তিনি আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন।
‘ঘুড়ি’ প্রথম যাত্রা শুরুর ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অনিমা বলেন, গত মে মাসের ৯ তারিখে ঘুড়ির যাত্রা শুরু। যাত্রাটা শুরু হয়েছিল হঠাৎ। তা-ও কোনো ধরনের বিনিয়োগ ছাড়াই। প্রথমে আমি পোশাকে হাতের কাজ করে এমন একজনের কাছে থেকে আমার পছন্দমত ১০টা জামা নিয়ে আসি চুক্তিতে। চুক্তিটা ছিল এমন বিক্রি হলে তাদের চাহিদা মত সেগুলোর দাম দিব। আর বিক্রি না হলে তাদের জামাগুলো ফেরত নিতে হবে। তবে মজার ব্যাপার হলো, শুরুর রাতেই একটি জামা বিক্রি হয়ে যায়। উদ্বোধনী ১০ শতাংশ ছাড় চলছিল তখন। তাই জামাটি ১ হাজার ৩৯৫ টাকায় বিক্রি করি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয় নি। বিক্রি হতে থাকে একের পর এক জামা।
অনিমা বলেন, সবাই যখন আমাদের গোছানো কাজ, ইউনিক ডিজাইন, প্রেজেন্টেশন, ম্যানেজমেন্টের প্রশংসা করেন তখন বুঝতে পারি যে, এটা শখ থেকে একটা অত্যন্ত প্রফেশনাল অবস্থানে পৌঁছাতে পারে।
মাত্র তিন মাসে যে অসম্ভব রকমের সাড়া পেয়েছি তাতে এই বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। ঘুড়ি শুধু আমাকেই স্বাবলম্বী করে নি, আমার পাশাপাশি গ্রামের যারা হাতের কাজে পারদর্শী তাদেরও কিছুটা আয় বৃদ্ধিরও ব্যবস্থা করেছে। তারা যাতে তাদের কাজের যতটা সম্ভব নায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।
অনিমা চৌধুরীর মতে, মেয়েদের উদ্যোগী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অনেক উপায় রয়েছে। এর জন্য শুধুু একটু পরিশ্রম এবং সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন। অনিমা উদ্যোগী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ফেইসবুক শপ বেছে নিয়েছেন। তার মতে যেকোনো মেয়েই তার নিজের আগ্রহের জায়গায় অবিচল থেকে তার স্বপ্ন সফল করতে পারে। এর জন্য তার দরকার একাগ্রতা।
অনিমা অনলাইন শপ ‘ঘুড়ি’র সংগ্রহ সম্পর্কে বলেন, আমাদের সংগ্রহে বর্তমানে পুরোপুরি হাতের কাজ করা আনস্টিজ জামা রয়েছে। রয়েছে ওয়ান পিস, টু পিস আর থ্রি পিস। তবে সামনে পহেলা বৈশাখে ঘুড়ির স্পেশাল কালেকশনে থাকবে হাতের কাজ করা শাড়ী ও পাঞ্জাবি। ‘ঘুড়ি’তে প্রতিটি পণ্যের অরিজিনাল ছবি দেয়া থাকে। একইসঙ্গে পোশাক পরে কেমন দেখা যাবে তা-ও ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়।
স/শ