রাজশাহীতে স্কুলের ভিতরে ঢুকে পড়েছে ব্যক্তি মালিকানা ভবন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

হালে নগরায়নের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমুল পরিবর্তনর এসেছে। বিশেষ করে স্কুলপর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেড়েছে নানা সুযোগ-সুবিধাসহ পড়া-লেখার মাণ। আর সেই কারণে শহরের অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন যেন শিক্ষার্থী ওভাবে ধুঁকছে। এ সেই সুযোগে এসব স্কুলের জায়গা-জমিসহ নানা সুবিধা হাতিয়ে নিদে শ্যানদৃষ্টি পড়েছে প্রভাবশালীদের। তাতে কোনো কোনো স্কুলের ভিতর ঢুকে গেছে সুউচ্চ ভবন। স্থানীয়দের এই দখলদারিত্বের কারণে নগরীর অন্তত তিনটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পড়েছেন চরম বেকায়দায়। স্কুলের জায়গা দখলের কারণে নগরীর গৌরহাঙ্গা ও কৃষ্ণকাণÍ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঠিকমতো জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও শরীর চর্চার স্থানটিও সংকির্ণ হয়ে গেছে। ফলে ঠিকমতো জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও শরীর চর্চা করাতেও পারছেন না শিক্ষকরা। এসব নিয়ে দফায় দফায় অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো দিনের পর স্কুলের জায়গা দখল হতেই আছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীর গৌরহাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একেবারে মূল ফটকের মাত্র ২ হাত দূরেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বহুতল ভবন। স্কুলের প্রাচীরটিও দেওয়া যায়নি এই ভবনের কারণে। এমনকি স্কুলে প্রবেশের পথটিতেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। যেন স্কুলের কক্ষের ভিতরই দাঁড়িয়ে আছে চার তলা ভবনের পেছনের অংশটি। স্কুলের গাঘেঁষেগড়ে তোলা সামনের এই ভবনের মালিকের নাম আব্দুল গফুর। তিনি একসময় রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তরে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ভবনের সামনের খাস জায়গাটি তিনি নিজের নামে করে নিয়েছেন। এখন তাঁর সন্তান নাইম ইসলাম মূলত জায়গাটির মালিক।

স্কুলের পশ্চিম পাশের টয়লেটে সামনে প্রাচীর ভেদ করে ঢুকে গেছে আরেকটি তিনতলা ভবন। এটির মালিক হলেন হানিফ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। দুটি ভবনের ছাদের পানিগুলোও স্কুলের ভিতরে এসে পড়ে।

বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর এক অভিভাবক রেজিনা খাতুন বসেছিলেন বিদ্যালয়ের সামনে গড়ে তোলা ভবনের পাশে রাখা একটি ব্যাঞ্চে। তিনি বলেন, ‘এখানে অভিভাবকরা আসলেও ঠিকমতো বসার জায়গা পান না। আর শিক্ষার্থীরা তো খেলা-ধুলার পরিবেশ পাই না। তাই হয়তো এই স্কুলে শিক্ষার্থী তেমন ভর্তি হচ্ছে না এখন। আগে অনেক শিক্ষার্থী ছিল।’

পাশেই গড়ে তোলা ভবনের পানি এসে পড়ায় বর্ষাকালে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত ও শরীর চর্চা করানো যায় না বলে দাবি করেছেন ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক সামাউল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি এখানেই। এই স্কুলেই আমি পড়া-লেখা করেছি। তখন কত শিক্ষার্থী ছিল। এখন মাত্র ১২৩ জন। স্কুলের সামনের খাস জায়গাগুলো সব দখল হয়ে গেছে। একজনের দান করা মাত্র ৫ কাঠার ওপর কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলটি। তার পরেও পাশের ভবন মালিকরা যে ভবনগুলো করেছেন, তারা এক হাত জায়গাও ছাড়েননি। এতে করে এখন প্রতিদিন সকালে ঠিকমতো শিক্ষার্থীদের অ্যাসেম্বলি করানোও যায় না। জায়গা না থাকায় ছেলেরা খেলা-ধুলা বা এক দৌড়া-দৌড়িও করতে পারে না। এখন পড়া-শোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা চায় একটু বিনোদনও। কিন্তু সেটি আমরা দিতে পারেনি। এ কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনকে দিন কমছেই।’

এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহিদা আক্তার বলেন, ‘শুনেছি আগে স্কুলের আশে-পাশে ও সামনের অংশ সব স্কুলেরই ছিল। পরে কিভাবে এসব দখল হয়ে ভবন গড়ে উঠেছে বলতে পারব না।’

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলাউদ্দিন বলেন, ‘যেসব ভবন গড়ে উঠেছে, সেগুলো স্কুলের জমিই ছিল। কিন্তু প্রভাবশালীরা এসব দখল করেছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে বার বার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। এ কারণে এখন স্কুলের ভিতরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ওয়েল্ডিংয়ের দোকানও। এ কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না। প্রশাসন চাইলে এসব ভবন গুড়িয়ে দিয়ে স্কুলের জন্য আবারও জায়গাগুলো ফাঁকা করে দিতে পারে। কিন্তু করবেটা কে?’


যদিও দুটি বভনের মালিকই দাবি করেছেন, তাঁরা যে ভবন গড়ে তুলেছেন, সেটি তাঁদের নিজেদের জায়গা। স্কুলের জায়গায় তাঁরা ভবন গড়ে তোলেননি।

এদিকে নগরীর বেলদারপাড়া এলাকায় কৃষ্ণকান্ত স্কুলের মাঠ দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয় পুজার প্যান্ডেল। এ কারণে সেখানেও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ঠিকমতো করতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘স্কুলের জায়গায় রাত-দিন আড্ডা বসে। এ নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না।’

অন্যদিকে নগরীর মন্নজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের জায়গা দখল করে হিরা নামের এক ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন ভবন। গত দুই বছর আগে গড়ে তোলা এ ভবন নির্মাণের সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক একাধিকবার স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। প্রভাবশালীর থাবায় স্কুলের ভিতরে চলে এসেছে ভবনের একটি অংশ।

প্রধান শিক্ষক কুমকুম ইয়াসমিন বলেন, ‘অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো আমাদেরই নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্কুলের জায়গা এভাবে দখল হতে থাকলে একসময় গোটা স্কুলই দখল হয়ে যাবে।’

তবে বাড়ি মালিক হিরা ইসলাম বলেন, ‘আমি আমার জায়গাতেই বাড়ি করেছি। স্কুলের জায়গাতে বাড়ি করার প্রশ্নই আসে না।’

জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, ‘নগরীর অন্তত তিনটি স্কুলের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। আমরা এ দখল ঠেকাতে পারিনি প্রভাবশালীদের কারণে। এ কারণে এসব স্কুলে শিক্ষার পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিনোদনের সুযোগও হারিয়েছে। এখন বড় ধরনের পদক্ষেপ ছাড়া এসব জায়গা দখলমুক্ত করা সম্ভব নয়।’

স/আর