রাজশাহীতে মাছ চাষের নেশায় কমছে ফসলি জমি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অধিক লাভের কথা চিন্তা করে রাজশাহীতে ফসলি জমিতে পুকুর করে মাছচাষের দিকেই ঝুকে পড়েছে চাষীরা। ফলে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল বাংলার চিরচেনা রূপ বিনষ্টের সঙ্গে কমে যাচ্ছে ফসলি জমি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ ও মৎস্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে মাছচাষ কয়েকগুণ বেড়েছে। আর কৃষিজমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টরেরও বেশি। কৃষিজমির একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। মাছচাষে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষিজমিতে পুকুরখননের এমন মহোৎসব অব্যাহত রয়েছে।

তবে মাছের উৎপাদন বাড়ায় সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস্য দপ্তর। কিন্তু কৃষি অধিদপ্তর বলছে, বাণিজ্যিক এসব পুকুর খনন হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। চাপও বাড়ছে পরিবেশের ওপর।

রাজশাহী মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে জেলায় পুকুরের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২৯৪ হেক্টর। এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর জমিতে। ২০১৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে মাছের খামার গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টরে। এর এক বছর পর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১৩ হাজার ১৫০ একর জমিতে বাণিজ্যিক মাছের খামার হয়েছে ৪৩ হাজার ১৯৬টি। চলতি বছরে ৮৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এই সূত্রটি জানিয়েছে।

এদিকে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। গত আট বছরে নতুন ৫ হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। ফলে কয়েক বছরে পুকুরসহ অন্যান্য কারণে শুধুমাত্র জেলায় ফসলি জমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টর।

কয়েক বছর ধরেই গোদাগাড়ী, পবা, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে।

শীত মৌসুমের শুরুতেই অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন হচ্ছে। অভিযোগ আছে, এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে চলেছে প্রশাসন, ক্ষমতাশীল দলের নেতা ও পুলিশ। পুকুর খনন বন্ধে কোন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। এতে একে অপরের ওপর দোষারোপ করে আখের গোছাচ্ছে অনেকে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কিছু অসাধু ব্যক্তি আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারসে চলছে খননযজ্ঞ। যেন পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। কমছে কৃষিজমি, বাড়ছে কৃষিশ্রমিকের বেকারত্ব। ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ নিরাপত্তা বেষ্টনী। আবাদের ফাঁকে ফাঁকে গরু-ছাগল পালনের তৃণভূমি থাকছে না। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই আইনে। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোকে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন তারা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারীজ বিভাগের অধ্যাপক এবিএম মহসিন বলেন, ‘কোন এলাকায় কতগুলো পুকুরের প্রয়োজন আছে এবং পরিবেশের ওপর সেগুলোর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেসব বিবেচনা না করেই যথেচ্ছভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এসব অপরিকল্পিত পুকুর কৃষকদের জীবন ও জীবিকা হুমকিতে পড়ছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, “ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনগুলোতে ভূমির ধরণ রূপান্তর করা নিষিদ্ধ। তাছাড়াও, ২০১৩ সালের বাংলাদেশ পানি আইনে প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রবাহকে বাধা দেওয়া কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়া, যেখানে পরিষ্কারভাবে কৃষি জমি রূপান্তরে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ আছে, সেটি এখনও পূর্ণতা পায়নি।”

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল বলেন, “জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুরের কারণে অনেক ধানি জমি কমেছে। তবে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরেও পুকুরগুলো কীভাবে গড়ে উঠেছে, সেটি বলতে পারব না।”

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলোক কুমার সাহা বলেন, “গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে প্রায় দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন বেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুরও বেড়েছে কয়েক গুণ। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলায় মাছ এখন উদ্বৃত্ত থাকছে। যা দেশের বিভিন্ন জেলা এবং দেশের বাইরে রপ্তানি করে বিপুল অর্থ আয় হচ্ছে।”

তবে রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল জলিল বলেন, “আইন অমান্য করে ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন বন্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধ এই পুকুর চলাকালে আমরা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে খনন বন্ধ ও জরিমানাও করা হয়েছে। এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

এএইচ/এস