রাজশাহীতে বছরে হাজারও পুকুর খনন: নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ জনপথ, হারিয়েছে কৃষি জমি

ফাইল ফটো

নিজস্ব প্রতিবেদক:
গত বছর এই সময়ে রাজশাহীর হোজা বিলের মাঝের রাস্তাটি কার্পেটিং করা হয় প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু চলতি বছর বর্ষাও পার হতে পারলো না। এরই মধ্যে রাস্তাটি ভেঙে-চুরে একাকার। এর কারণ হলো মাটি বহনকারী ট্রাক্টরের থাবা। বিলের মাঝে একের পর এক খনন হচ্ছে পুকুর । আর সেই পুকুরের মাটি চলে যাচ্ছে ট্রাক্টরে করে দূর-দূরান্তে। ট্রাক্টরে বহনকৃত মাটি রাস্তাতেও পড়ে লেপ্টে যাচ্ছে। একটু বৃষ্টিতেই সেই মাটিতে গোটা সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। আবার ভারি ট্রাক্টরের অবাধ যাতায়াতে রাস্তা ভেঙে হয়েছে চৌচির।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হোজা বিলের চারিদিকে যেদিকে নজর যায় শুধু পুকুর আর পুকুর। গত শীত থেকে শুরু করে এখনো বিলের কোনো কনো স্থানে পুকুর কাটা চলছে। রাজশাহীর দুর্গাপুরের শুধু এই বিলেই নয়, আশে-পাশের উজান খলশি, নওপাড়া, দাওকান্দিসহ বাগমারা, পবা, মোহনপুর, তানোর, পুঠিয়া ও চারঘাটে ব্যাপক হারে এবার পুকুর খনন হয়েছে বা হচ্ছে। আর এতে করে গ্রামের নতুন পুরনো কার্পেটিং রাস্তা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তেমনি ব্যাপক হারে হারিয়েছে কৃষি জমি। আবার আগামী বর্ষা মৌসুমে ব্যাপকহারে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছর বর্ষা মৌসুমে শুধুমাত্র পুকুর খননের জন্য বাগমারায় ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। এ বছরও একই হারে বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাগমারাসহ দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, চারঘাট ও তানোরে-এমনটিই মনে করছেন স্থানীয় কৃষকরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর বিভিন্ন বিলে এ বছর অন্তত এক হাজার পুকুর খনন হয়েছে। কেবল দুর্গাপুরেই অন্তত ৬০০ পুকুর খনন হয়েছে বিভিন্ন বিলে। আর এসব পুকুর খননের পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কোনো অনুমতি ছাড়ায় পুকুরগুলো খনন হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। এতে করে স্থানীয় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে শতাধিক লিখিত অভিযোগ জমা হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার কখনো কখনো লোক দেখানো পুলিশ গিয়েও আবার ফিরে এসেছে। দুই-একটা যায়গায় অভিযানও চালাতেও দেখা গেছে। কিন্তু বন্ধ করা যায়নি পুকুর খনন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে পবার একটি বিলের মাঝে অন্তত ৪০ বিঘা জায়গা দখল করে পুকুর খনন করা হচ্ছে। পুকুরটি খনন করছেন পারিলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন ও হরিয়ান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু। তাঁরা দু’জনেই আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের দাপটে স্থানীয় কৃষকদের কৃষি জমি বছর চুক্তিতে অনেকটা জোর করে বন্ধক নিয়ে পুকুর খনন হচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। বরং দুই নেতার দাপটে তটস্থ হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।

স্থানীয় আকবর হোসেন বলেন, ‘প্রতিবাদ করেছি। কোনো লাভ হয়নি। তারা আওয়ামী লীগের নেতা। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এভাবে এ উপজেলায় চলতি বছরে শতাধিক পুকুর খনন হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে করে কৃষি জমি যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হেয়ছে, তেমনি পুকুর খননের মাটি পরিবহণের জন্য নতুন-পুরাতন গ্রামীণ রাস্তাগুলো ভেঙে-চুরে একেকার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে বসে আছে।’

দুর্গাপুরে জুগিশো গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, চোখের সামনেই খেতের জমি কেটে পুকুর হয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলার নাই। শুধু আওয়ামী লীগের লোকজনকে ম্যানেজ করে প্রশাসনকে কিছু টাকা দিয়ে আসলেই পুকুর কাটা হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি।

রাজশাহীর বাগমারার মাঝিড়া গ্রামের মাজিদুল বলেন, গোটা বাগমারাজুড়েই এবার পুকুরে ভরে গেছে। অন্যান্য বার প্রশাসন ব্যাপক বাধা দিত। ফলে পুকুর খনন হলেও এতোটা করার সাহস পেত না। কিন্তু এবার কোনো বাধা না থাকায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই যাচ্ছে-তাই ভাবে পুকুর খনন হয়েছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি। অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।

এদিকে পুকুর খনন বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, পুকুর খনন নিয়ে কিছু বলার নাই। বাধা দিয়েও কোনো লাভ হয় না। আর জমি যার, তিনি তার অধিকার রাখেন সেখানে কি করবেন।’

স/অ