রাজশাহীতে একনেকের অনুমোদিত জায়গা ছেড়ে পুকুরের মধ্যে হচ্ছে সার গুদাম

নিজস্ব প্রতিবেদক:
সার সংরক্ষণ ও বিতরণের সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)। ৩৪টি বাফার গুদামের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পও অনুমোদন হয়েছে। এর একটি গুদাম হবে রাজশাহীতেও। কিন্তু রাজশাহীর যে স্থানের জন্য একনেক অর্থ দিয়েছে সেই স্থানটি হঠাৎই বদলে ফেলা হচ্ছে। এখন শর্ত লঙ্ঘন করে নদী ও রেলপথ ছাড়ায় একটি পুকুরের মধ্যে বাফার গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অথচ সারাদেশে পুকুর ভরাট বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে উচ্চ আদালত। সেই নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে রাজশাহীতে প্রায় দুই বিঘারও বেশি আয়তনের পুকুর থাকা জমি নির্বাচন করা হয়েছে গুদাম নির্মাণের জন্য।

অবশ্য পরিবেশ অধিদপ্তর এক চিঠিতে পুকুর ভরাটে নিষেধাজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে প্রকল্পের পরিচালককে। তারপরও শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জায়গা পরিবর্তন করে এরই মধ্যেজমি অধিগ্রহণে চলছে তোড়জোড়।

এদিকে, ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। যার মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু হঠাৎ জমি পরিবর্তন করতে গিয়ে এখনো এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণই শেষ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। ফলে প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাজশাহীতে কোনভাবেই গুদাম নির্মাণ সম্ভব নয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৫ লাখ মেট্রিক টন। আপদকালীন চাহিদা মেটাতে সব সময় আট লাখ মেট্রিক টন সার মজুদ রাখতে হয়। কিন্তু সার মজুদ রাখার পর্যাপ্ত গুদাম নেই শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিসিআইসির। সে জন্য ‘সার সংরক্ষণ ও বিতরণের সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

প্রকল্পটি গ্রহণের আগে রাজশাহী মহানগরীর পশ্চিমপ্রান্তে কাশিয়াডাঙ্গা ও গোয়ালপাড়া মৌজার জমি পছন্দ করা হয়। ২৫ হাজার মেট্রিক টন সার ধারণক্ষমতার গুদাম নির্মাণ করতে এ দুই মৌজার ৬ দশমিক ৯৮ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রস্তাবিত জমি নির্বাচনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, নৌপথ, রেলপথ ও সড়কপথে যোগাযোগ সম্ভব। এছাড়া এই জমি স্বল্প সময়ে অধিগ্রহণ সম্ভব বলেও উল্লেখ করেন প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবুল কাশেম।

কাশিয়াডাঙ্গা ও গোয়ালপাড়া মৌজার জমিতে বাফার গুদাম নির্মাণের ব্যাপারে অনাপত্তি দেয় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ), পরিবেশ অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তর। এ নিয়ে সব প্রক্রিয়ায় চলছিল। কিন্তু কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় গুদাম নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তোলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা শাখা। স্থান পরিবর্তনের জন্য সংগঠনটি আবেদনও করে। আর এর প্রেক্ষিতে জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির একটি সভা হয়। গত বছরের ৬ আগস্ট ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই কমিটি জমি পরিবর্তনের জন্য বিসিআইসিতে প্রস্তাব পাঠায়। বিসিআইসি কোনো সম্ভাবতা যাচাই ছাড়ায় সেই সিদ্ধান্তটি মেনেও নেয়। পরে আগের অনুমোদিত জায়গা ছেড়ে ব্যবসায়ীদের পছন্দ করা জায়গা জেলার পবা উপজেলার বায়া এলাকায় বাফার গুদাম নির্মাণের প্রক্রিয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অনুমোদিত ওই কাগজপত্র থেকে দেখা গেছে, বায়া মৌজায় ৬ দশমিক ৯৮ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিআইসি। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৭১ একর জমির শ্রেণি পুকুর। এছাড়া ১ দশমিক ১২ একর জমির ধরণ পুকুর পাড়। গুদাম নির্মাণ করতে হলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এর সবটুকুই ভরাট করতে হবে। অথচ কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার জমিতে পুকুর নেই। এই স্থানটির পাশ দিয়েই চাঁপাইনবাবগঞ্জ গেছে রেললাইন। পাশ দিয়েই বহমান পদ্মা নদী। আর মহাসড়ক তো আছেই। এখানে গুদাম থাকলে রেলপথ ও নৌপথ ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের খরচ কমানোর সুযোগ ছিল। অথচ বায়া এলাকার নতুন স্থানটির সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগ সম্ভব নয়। নেই রেললাইনও। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রকল্প পরিচালক এই স্থানটি পছন্দের কারণ হিসেবেও নৌপথ, রেলপথ ও সড়কপথ যোগাযোগ সহজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বায়া এলাকায় যে স্থানটিতে বাফার গুদাম নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে তার পাশেই রয়েছে রাজশাহীর হজরত শাহমখদুম (রহ.) বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটি আধুনিকায়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করে এটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে কার্গো বিমান ওঠানামার ব্যবস্থা করার দাবিও রয়েছে রাজশাহীবাসীর। কিন্তু ওই এলাকায় বাফার গুদাম হলে বিমানবন্দরের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে অনেকেই মনে করছে। তাছাড়া রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে গুদামের ট্রাকের জন্য দেখা দিবে যানজট। এ অবস্থায় আগের স্থানেই গুদাম নির্মাণের জন্য সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী-২ (সদর) আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আদিবা আনজুম মিতা আধা-সরকারি (ডিও) চিঠি দিয়েছেন। তারপরও বায়া থেকে সরে আসছে না বিসিআইসি। বায়ার জমি অধিগ্রহণে শুরু হয়েছে তোড়জোড়।

গুদামের স্থান পরিবর্তনের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে দেখা গেছে, সভায় প্রকল্প পরিচালকের পক্ষে সহকারী প্রকৌশলী (পুর) শফিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি মতামত দেন- ডিলারসহ সাধারণ মানুষ যেখানে সুবিধা পাবে সেখানেই গুদাম নির্মাণ করা উচিত। বায়ার কাছেই রয়েছে ট্রাক টার্মিনাল। এর ফলে ডিলাররা সুবিধা পাবেন। ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলার সভাপতি ওছমান আলী সভায় বলেছিলেন, কাশিয়াডাঙ্গায় গুদাম হলে সার নিতে তাদের খরচ বেশি হবে। বায়ায় গুদাম হলে ডিলাররা বেশি সুবিধা পাবে। তাই সেখানেই গুদাম নির্মাণ করা প্রয়োজন। তাদের এমন মতামতের পর বায়ায় গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ এখানে সার আনার জন্য একমাত্র সড়কপথ ছাড়া আর কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। কাশিয়াডাঙ্গার সঙ্গে নৌপথ, রেলপথ এবং সড়কপথের খুবই সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই গুদামের স্থান পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে। এই জমিতেই রয়েছে পুকুর।

তবে জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেছেন, সার গুদাম নির্মাণের জন্য পুকুর ভরাট করা হবে না। পুকুর রেখেই গুদাম করা হবে। তিনি বলেন, ‘ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন তাদের সুবিধার জন্য বায়ায় গুদাম নির্মাণের দাবি করে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। এখানে গুদাম করলে সরকারের এক কোটি ৩৭ লাখ টাকাও বাঁচবে। এখন আবার জায়গা পরিবর্তন করে কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় আসতে হলে প্রকল্পটিই বাস্তবায়ন হবে না। কারণ, ইতোমধ্যে অনেকটা সময় চলে গেছে।’

তবে এ নিয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি প্রকল্পের পরিচালক আবুল কাশেম।

স/অ