আরডিএ’র জনবল সঙ্কটে চরমে

রাজশাহীতে অবৈধ ভবন নির্মাণেরর হিড়িক

নিজস্ব প্রতিবেদক:


গত বছরের শুরুর দিকে রাজশাহী নগরীর মহিষ বাথান এলাকায় ১০ তলা একটি বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেন শরিফুল ইসলাম বাবু নামের এক ব্যক্তি। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) নীতিমালার বাইরে গিয়ে ওই বাড়িটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে তখন অভিযোগ করেন প্রতিবেশী সওগাতুল ইসলাম। কিন্তু অভিযোগ করার পর আর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি আরডিএ। আর সেই সুযোগে কোনো বাধা ছাড়ায় ওই ভবনের অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করেছেন বাড়ি মালিক।



অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেবলমাত্র গত তিন মাসেই আরডিএতে এমন অন্তত শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। বলা যায়, প্রতিদিনই একটার পর একটি অভিযোগ জমা পড়ছে। কিন্তু জনবল সঙ্কটের কারণে সেসব অভিযোগ নিয়ে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না আরডিএ কর্তৃপক্ষ। এমনকি অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলেও জনবল সঙ্কটের কারণে তাঁকে কাজ করতে হচ্ছে হিসাব শাখায়। ফয়সাল রায়হান নামের ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরডিএর ভারপ্রাপ্ত হিসাব রক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। গতকাল রবিবার হিসাব শাখায় গিয়েও ফয়সাল রায়হানকে ওই শাখার কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।

এসময় তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রচণ্ড জনবল সঙ্কটের কারণে আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে হিসাব শাখায় কাজ করছি। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত পুরনো দুটি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছি। এগুলো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় স্থগিত ছিল। তবে এখনো অনেকেই আসছেন আমার কাছে নানা অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু জনবল সঙ্কটের কারণে সব কাজ করা যাচ্ছে না।’

আরডিএ সূত্র মতে, সংস্থাটির সবমিলিয়ে ১০৫ জন জনবলের স্থলে কর্মরত রয়েছেন প্রায় অর্ধশত। তাঁদের মধ্যে কেউ রয়েছেন অসুস্থজনীত কারণে ছুটিতে। ফলে চরম জনবল সঙ্কটে ভূগছে নগর উন্নয়নের বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানটি। যার কারণে নগরবাসীকেও নানা সেবা পেতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
এদিকে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আরডিএ কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অনেকটা হতাশা নিয়ে হাতে একটি কাগজের ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আব্দুল ওহাব নামের এক ব্যক্তি। কি কাজে এসেছিলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় দুউ বছর ধরে ঘুরছি পল্টের সীমানা বুঝে নেওয়াসহ আনুসঙ্গিক কাজের জন্য। কিন্তু স্ট্যাট শাখা সেই কাজ করতে পারেনি। আবার বুধবার পর্যন্ত সময় নিয়েছে। জনবল সঙ্কটের কারণে তারা কার্যক্রম আগাতে পারছে না বলে জানাচ্ছে। এরা কাজও করে না ঠিকমতো। ফলে ভোগান্তি হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের।’

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক আরেক ব্যক্তি বলেন. আমি একটি জমির প্লান পাশের জন্য জরুরী ভিত্তিতে এনওসি (অনাপত্তি পত্র) নিতে আবেদন করেছি। কিন্তু আমার আবেদনটি পড়ে আছে। অথচ পরে যারা আবেদন করেছে, তাদের অনেকেরই এনওসি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ঘুরছি গত এক মাস ধরে। আমি হয়তো অতিরিক্ত টাকা দেয়নি তাই আমারটা হয়নি।’
মহিষ বাথান এলাকার সওগাতুল ইসলাম বলেন, ‘আমার প্রতিবেশী যে বহুতুল ভবনটি নির্মাণ করছেন, সেটি অনেকাংশে অবৈধ। তিনি কোনো যায়গাও ছাড়েননি। এ নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।’

তবে শরিফুল ইসলাম দাবি করেন, তিনি নিয়ম মেনেই বাড়ির নির্মাণ কাজ করছেন। প্রতিবেশীরা যেসব অভিযোগ তুলেছেন, সেগুলো সঠিক ছিলো না। তাই আরডিএ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

চন্ডিপুর এলাকার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নির্মাণের শর্ত উপেক্ষা করে একেবারে সীমানাঘেঁষে বাড়ির পিলার তুলেছেন প্রতিবেশী শাহীনসহ তাঁদের ওয়ারিশরা। ফলে বাড়ির ওপরের কিছু কিছু অংশ গিয়ে অন্যের জমির ওপর পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এলাকাবাসীর পক্ষে অভিযোগ করেছি। কিন্তু বিষয়টি তদন্ত করে যে কোনো ব্যবস্থা নিবে আরডিএ, সেটিও করেনি।’ জানতে চাইলে শাহীন আলম বলেন, ‘আমরা পুরনো বাড়ির বর্ধিত কাজ করলেও কোনো অনিময় করিনি। সীমানার বাইরে কোনো কাজও করা হচ্ছে না।’

অপরদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকায় ড্রিম ৩২ নামের একটি বাড়ি আরডিএ’র নিষেধাক্কা অমান্য করে ১০ তলা থেকে ১১ তলা করা হয়। এর বাইরেও বহুতুল ওই বভনটি নির্মাণের নানা অয়িমের আশ্রয় নেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তিতে আরডিএ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

এভাবে নগরজুড়ে শত শত ভবন গড়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে নানা অনিয়মের মাধ্যমে। এসব ভবন পরিদর্শনের মতোও জনবল গড়ে তুলতে পারেনি আরডিএ। এমনকি স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে একের পর এক অভিযোগ করা হলেও জনবল সঙ্কটের কারণে সেসব অভিযোগেরও সুরাহা করতে পারছে না আরডিএ। ফলে অবৈধ ভবন বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়ম-নীতিহীন ভাবে নির্মাণের হিড়িক চলছেই।

এদিকে আরডিএর অফিসিয়াল সূত্র মতে, সংস্থাটির মোট জনবল কাঠামো রয়েছে ১০৫ জন। সেখানে এখন কর্মরত রয়েছেন সাকূল্যে অর্ধশত। যাঁদের কেউ অসুস্থজনিত কারণেও ছুটিতে রয়েছেন। সম্প্রতি আরডিএতে যোগ দিয়েছেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জনবল সঙ্কটের কারণে ফয়সাল রায়হান নামের ওই কর্মকর্তা এখন কাজ করছেন হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, ওই শাখায় প্রধান হিরাবরক্ষক এমনকি হিসাবরক্ষ পদটিও শূন্য রয়েছে। এর বাইরে আরডিএতে প্রকৌশল শাখায় সহকারী প্রকৌশলী ৪ জনের স্থলে রয়েছেন ২ জন, উপসহকারী প্রকৌশলী ৭ জনের স্থলে রয়েছেন ৩ জন, অথোরাইজড শাখায় ৯ জন পরিদর্শকের স্থলে রয়েছেন মাত্র ৩ জন। এভাবে প্রতিটি শাখায় অর্ধেকের মতো জনবল সঙ্কট রয়েছে। যার কারণে সেবাপ্রার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এখানে নানা সেবা নিতে গিয়ে।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জনবল সঙ্কট রয়েছে অনেকটা। সেটি নিরসনের চেষ্টাও করা হচ্ছে। তবে অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তার পরেও জনবল সঙ্কটের কারণে নানা সমস্যা তো থেকেই যাচ্ছে।’

স/আর