যেসব লক্ষণে বুঝবেন উচ্চরক্তচাপ, প্রতিকার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

উচ্চরক্তচাপ একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা। হঠাৎ রক্তচাপ অনেক বেড়ে গেলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও সৃষ্টি হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা নিয়ে উচ্চরক্তচাপের রোগীরাও নিরাপদ জীবন পেতে পারেন।

উচ্চরক্তচাপের উপসর্গ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন।

মানবদেহের রক্তচাপ সাধারণত ১২০/৮০। এর চেয়ে বেশি হলে এবং তা দীর্ঘসময় স্থির থাকা বা বেড়ে গেলে অবশ্যই সেটার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা দরকার। এক্ষেত্রে রক্তচাপের পরিমাণ ১৪০/৯০ থাকলে চিকিৎসা নেওয়া অবশ্যই দরকার। তেমনি রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলেও সেটার চিকিৎসা নিতে হবে।

তবে কারও যদি ১৩৫/৮৫ হয় সেটা বেশি কিন্তু ওষুধ লাগবে না। তার সতর্কতা হিসাবে ভাত খাবার সময় লবণ বাদ দিতে হবে। ওজন বেশি থাকলে কমাতে হবে। স্ট্রেস কমাতে হবে।

৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে সবার ডায়াবেটিস, কোলস্টেরল পরীক্ষা করতে হবে। অন্যদের বেলায় বিশোর্ধ্ব হলে, স্থুলকায় হলে, বংশে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস, ব্লাড প্রেশার বেশি থাকলে এগুলো পরীক্ষা করতে হবে।

* উপসর্গ : অধিকাংশ লোকই বুঝতে পারে না তার উচ্চরক্তচাপ আছে, অর্থাৎ উচ্চরক্তচাপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গবিহীন। এ জন্যই উচ্চরক্তচাপকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার বা নীরব ঘাতক। যেটা আবশ্যক তা হলো নিয়মিত রক্তচাপ চেক করা। যে উপসর্গগুলো হতে পারে তা হলো :

* মাথা ধরা- বিশেষ করে ভোরে বা শেষ রাতে মাথা ধরা। এর সঙ্গে ঘেমে যাওয়া বিশেষ করে রাতের শেষের দিকে ঘামা। মাথাব্যথার সঙ্গে ঘাড়ে ব্যথা বা পিঠের উপরের দিকে ব্যথা বা জ্যাম লাগার অনুভূতি হতে পারে। এর সঙ্গে কান বন্ধ লাগতে পারে; দৃষ্টি শক্তির পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে পারে।

* উচ্চরক্তচাপকে নাক দিয়ে রক্তক্ষরণের কারণ বলে সাধারণের ধারণা থাকলেও এটা ঠিক নয়। টেনশনে অনেকের প্রেশার কিছুটা বাড়লেও শুধু প্রেশারের চিকিৎসাতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না।

* অনেক বেশি প্রেশার হলে (বিশেষ করে বয়স্কদের) দাঁড়ালে দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, মতিভ্রম, সন্তস্ত হওয়া, বমি লাগা, গা কাপা ইত্যাদি হতে পারে।

* উচ্চরক্তচাপের জন্য রক্তনালি শক্ত হয়ে যায় ফলে রক্ত সাপ্লাই কমে যায়। সেজন্য এনজাইনা বা হার্টের ব্যথা, হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন, হার্টের দুর্বলতা/হার্ট ফেইলুরের উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে। একই কারণে ব্রেইন বিকল/স্ট্রোক, কিডনি বিকল/রেনাল ফেইলুরের উপসর্গ পাওয়া যেতে পারে হাইপ্রেসারের রোগীদের।

রক্তচাপ পরীক্ষা করার টেকনিক এবং পারিপার্শ্বিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। চেয়ারে পিঠ সোজা করে হাত টেবিলের ওপর সটান রেখে পা মাটিতে মেলে আরামে বসতে হবে, কথা বলা যাবে না। ডিজিটাল মেশিনে মাপা গ্রহণযোগ্য তবে ভালো হবে চিকিৎসকের চেম্বারে দেখা কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার পড়ে।

প্রথমবার পরীক্ষায় যদি রক্তচাপ বেশি পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে উচ্চরক্তচাপের ওষুধ দেওয়া উচিত না। তবে যদি প্রেসার ১৮০/১১০ এবং যদি কারও স্ট্রোক করে সেক্ষেত্রে প্রথমবারেই চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। চেম্বারে বা বাসায় ২-৩ বার ১-৪ সপ্তাহ পর পর মেপে যদি প্রেসার বেশি হয় তবেই সেটার চিকিৎসা করতে হবে।

* হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন : অনেকেরই ডাক্তারের চেম্বারে মাপলে প্রেশার বেশি পাওয়া যায়; চেম্বারের বাইরে মেপে নিশ্চিত করতে হবে।

* এসেন্সিয়াল হাইপারটেনশন : উচ্চরক্তচাপের ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, এজন্য একে বলে এসেন্সিয়াল হাইপারটেনশন।

* সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন : ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ পাওয়া যায় বলে তাকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন বলে। ৩০ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে বেশি প্রেশারের কারণ খুঁজতে হবে কারণ এদের অনেকেরই কারণ পাওয়া যায় অর্থাৎ সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন হয়। প্রেসারের কারণের চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ ভালো হওয়া সম্ভব।

* সিস্টলিক হাইপারটেনশন : শুধু উপরের প্রেসার (systolic) ১৪০-এর বেশি থাকলে নিচের (diastolic) স্বাভাবিক (৯০ এর কম) থাকলে সেটা সিস্টলিক হাইপারটেনশন।

উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসা

* জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে হবে : খাওয়া দাওয়া, ওজন কমানো, বিশ্রাম, শারীরিক পরিশ্রম পরিমিত করতেই হবে। ধূমপান হারাম করতে হবে। পাতে লবণ বাদ দিতে হবে।

* ওষুধ : নিয়ম হলো ১৪০/৯০ হলেই ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে; ১৬০/১০০ হলেই দুটি ওষুধ দিয়ে শুরু করতে হবে। নীতি হবে প্রেশার নামাতে হবে অর্থাৎ ১৩০/৮০ বা তার নিচে আনতে হবে, যত ওষুধ লাগে লাগুক। তবে ১২০/৭০-এর নিচে রাখা যাবে না।

সিংগল ট্যাবলেট কম্বিনেশন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি গ্রহণযোগ্য। ওষুধ পরিবর্তন বা বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। এক ওষুধে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বদল করা খুবই কঠিন। অনেক ওষুধ বাজারে আছে, যেটায় কাজ হয় সেটাই ভালো।

রাস ব্লকার (এসিই-ইনহিবিটর, এ-আরবি) ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো, পছন্দনীয়। কারণ প্রেশার কমানোর পাশাপাশি এরা প্রোটিনুরিয়া কমায়। ৫৫ বছর বয়সের বেশি রোগীদের এ দুটো ওষুধ এত কার্যকরী নয়। এ বয়সে ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (এন্টিসিসিবি-এমলডিপিন, সিলনিডিপিন) এবং থায়াজাইড লাইক ডাইরেটিক-(ক্লোরথায়জাইড) শ্রেষ্ঠতর। উপরের (সিস্টলিক) প্রেশার বেশি হলে ও এন্টিসিসিবি এবং থাইয়াজাইড লাইক ডাইরেটিক উত্তম।

* ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ : উচ্চরক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস থাকলে কোলস্টেরল বেশি থাকার আশঙ্কা বেশি, কিডনি রোগ, হার্টের রোগ, স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেশি। প্রেশার স্বাভাবিক রাখতে পারলে সমস্যা কম হবে; নিয়মিত ডাক্তারের ফলোআপে থাকতে হবে এবং পরামর্শানুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে।

* প্রতিরোধ : বংশে স্ট্রোকের ঘটনা থাকলে, ওজনাধিক্য থাকলে, ধূমপায়ী হলে, দীর্ঘসূত্রি কিডনির অসুখ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। উচ্চরক্তচাপ, রক্তে কোলস্টেরলাধিক্য, পূর্বে ঘটে যাওয়া স্ট্রোক স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকা এসব রোগী নিয়মিত স্টাটিন খেলে উপকার হবে। বয়স চল্লিশের বেশি হলে স্টাটিন খেলে উপকার হবে। একবার স্ট্রোক হলে বা হার্টএটাক হলে এসপিরিন/ক্লোপিডেগ্রল খেতে হবে। এগুলো না হলে প্রাথমিক প্রতিরোধ হিসাবে রুটিন এসপিরিন দেওয়ার দরকার নাই।

ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে। নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। ফল, শাক-সবজি বেশি খেতে হবে। চর্বি ছাড়িয়ে মাংস খেতে হবে, মাছ বেশি খেতে হবে। যে তেল জমে যায় (স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট) বাদ দিতে হবে। পাতে লবণ বাদ দিতে হবে। ধূমপান হারাম করতে হবে। চা কফি অ্যালকোহল সীমিত করতে হবে। স্ট্রেস কমাতে হবে। ৮ ঘণ্টা বিছানায় থাকুন; সাত ঘণ্টা ঘুমাতে হবে (৫-এর কম নয় ৯ ঘণ্টার বেশি নয়)।

 

সুত্রঃ যুগান্তর