‘যুদ্ধের সময় পাক-বাহিনী রাবির পুকুরে তিন শতাধিক মর্টারশেল ফেলে গিয়েছিল’

আমজাদ হোসেন শিমুল:

স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় আনুমানিক প্রায় তিন শতাধিক মর্টারশেল ও রকেট লাঞ্চার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সামনের পুকুরে ও হলের আশেপাশে ডোবা জায়গায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার সময় ফেলে যায়। সেগুলোই বর্তমানে পুকুর খননের পর পাওয়া যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি এলাকার পাশের একটি পুকুর থেকে আরও ২টি মর্টার শেল, ১টি রকেট লাঞ্চার ও একটি মাইন  উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি এলাকার পুকুরে মর্টার সদৃশ একটি বস্তু দেখতে পেয়ে এক কর্মচারি পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে এগুলো উদ্ধার করে পুকুরের পাশেই একটি ফাঁকা জায়গায় ঘেরাও করে রাখা হয়েছে।

এর আগে গত ২৭ এপ্রিল একই স্থান থেকে একটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল উদ্ধার করেছিল র‌্যাব-৫ এর একটি দল। পরবর্তীতে এর পরদিন সেনাবাহিনীর বোমা নিস্ক্রিয়কারী দল এসে শেলটি নিস্ক্রিয় করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা দখল করে এটিকে ক্যান্টনম্যান্ট বানিয়েছিলো। জোহা হল থেকেই তারা রাজশাহী অঞ্চলের নিরীহ বাঙালিদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতো। এমনকি জোহা হলে নিরীহ রাজশাহীবাসীকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করতো। এছাড়া এই অঞ্চলের কিশোরী ও নারীদেরকেও ধরে এনে সম্ভ্রম হানি করে বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালাতো। যুদ্ধের পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা চলে যাওয়ার সময় জোহা হলের পাশের পুকুরে ব্যাংক থেকে লুণ্ঠিত টাকা-পয়সা এবং বেশ কিছু মর্টার শেল ও রকেট লঞ্চার ফেলে যায়।

এবিষয়ে রাজশাহীর প্রবীণ সাংবাদিক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী জোহা হলকে ক্যান্টনম্যান্ট বানিয়েছিলো। যুদ্ধের সময় এখান থেকেই তারা অত্যাচার-নির্যাতন বিভিন্ন জায়গায় চালাতো। তারা এই অঞ্চলের বাড়ি-ঘর পোড়াতোসহ নির্মম হত্যাযজ্ঞ তো চালিয়েছেই। পাশাপাশি ব্যাংক লুট করে টাকা পয়সা পুুড়িয়ে দিয়েছে। তবে আত্মসমর্পণ করে চলে যাওয়ার সময় তারা গোলা-বারুদ (মর্টারশেল, রকেট লাঞ্চার), কয়েনসহ কিছু টাকা-পয়সা (যেগুলো পোড়ানো হয়নি) ও অস্ত্র জোহা হলের সামনের পুকুরে ফেলে রেখে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের কয়েকমাস পরে এই পুকুরে জেলেরা জাল ফেলে এসব টাকা-পয়সা ও অস্ত্র, গোলাবারুদের কিছুটা উদ্ধার করেছিলো। এই ঘটনার সংবাদ আমি করেছিলাম। পরীবর্তীতে বদ্ধভূমি থেকে একটি মানুষের মাথার খুলি ও একটি রকেট লাঞ্চার আমার সংরক্ষণে রেখেছিলাম। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে যখন শহীদ স্মৃতিসংগ্রহশালা হলো তখন আমি এগুলো সেখানে জমা দিই। যা এখনো সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা নাটোরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এর আগে বেশ তাড়াহুড়ো করেই রাজশাহী ত্যাগ করে। যাওয়ার সময় তারা কিন্তু সব অস্ত্র নিয়ে যেতে পারেনি। শুধু মেশিনগান, রিভলবারসহ বড় বড় অস্ত্রগুলো নিয়ে যায়। কিন্তু মর্টারশেল ও রকেট লাঞ্চার তারা জোহা হলের সামনের পুকুর ও এর আশেপাশের নিচু জায়গায় ফেলে চলে যায়। আমরা ধারণা মতে, প্রায় তিন শতাধিক মর্টালশেল ও রকেট লাঞ্চার তারা ফেলে যায়। স্বাধীনতার যুদ্ধের পর রাবির এসব পুকুর খনন করা হয়নি বা এগুলো উদ্ধারের জন্য কোনো তৎপরতা চালানো হয়নি। সম্প্রতি এসব পুকুর খননের কাজ শুরু হওয়ায় এই মর্টারশেল ও রকেট লাঞ্চারগুলো মাটির নিচে থেকে আস্তে আস্তে উদ্ধার হচ্ছে।’

এ ব্যাপারে রাবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘পুকুরে বা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় হয়তো এসব মর্টারশেল বা রকেট লাঞ্চার আরও রয়েছে। এগুলোর দ্বারা মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য এর স্থায়ী একটি সমাধানের জন্য আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মৌখিকভাবে জানিয়েছি। তারা লিখিতভাবে সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি দরখাস্ত দিতে বলেছেন। আমরা সেটি দিবো। আর উদ্ধার হওয়ার মর্টারশেল ও রকেট লাঞ্চারটি ঘেরাও করে পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে। পূর্বের মতো বগুড়া থেকে সেনাবাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এসে এগুলো নিষ্ক্রিয়করণে কাজ করবে বলে মতিহার থানা পুলিশ আমাদেরকে জানিয়েছে।’

এ ব্যাপারে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সেনাবাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটকে বিষয়টি জানিয়েছি। হয়তো তারা আগামীকালের (আজ শনিবার) মধ্যে ঘটনাস্থলে এসে এগুলো নিষ্ক্রিয়করণে কাজ করবে।’

এএইচ/এস