যা আছে সড়ক পরিবহন আইনে, মালিক-শ্রমিকরা যা চান

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এখনও আলোর মুখ দেখেনি ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। জাতীয় সংসদে পাস শেষে রাষ্ট্রপতির সই হয়ে গেজেট প্রকাশের পরও আইনটি কার্যকর করা হয়নি। এই আইনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা রাখা হয়েছে। এসব ধারার মধ্যে অধিকাংশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা। একইসঙ্গে আইনের এসব ধারার পরিবর্তনসহ সব ধারায় জামিনের বিধান রাখারও দাবি তুলেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এখনও কার্যকর করেনি সরকার।

‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এই আইনে শিক্ষাগত যোগ্যতা, মৃত্যুদণ্ড ও বয়সের বিষয়টি শিথিলসহ কয়েকটি ধারার পরিবর্তন চান মালিক ও শ্রমিকরা। মালিক শ্রমিকদের আপত্তির কারণেই মূলত আইনটি এখনও কার্যকর করা হয়নি। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-বিল’টি সংসদে তোলা হয়। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর ৮ অক্টোবর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এর আগে একই বছরের ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। তবে আইনটির ১-এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির গেজেটের পর আইনটি কার্যকর করতে সরকারের পক্ষ থেকেও গেজেট প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু মালিক শ্রমিকদের আপত্তির কারণেই সরকার সেই গেজেট এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি, তাই এখনও কার্যকর হয়নি আইনটি।

জানা গেছে, মালিক ও শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী বর্তমানে আইনটি সংশোধন পরিবর্তনের কাজ চলছে বলা হলেও এখন পর্যন্ত আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন মহলের অভিমত নেওয়া হচ্ছে। সংশোধন শেষে আইনটি সব প্রক্রিয়া শেষ করে কার্যকর করতে আরও কিছু সময় লাগবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

এদিকে, গত ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী ৬টি নির্দেশনা দিয়েছেন। সেসব নির্দেশনা হচ্ছে—১. দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখতে হবে। ২. একজন চালক দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৩. গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করতে হবে। ৫. অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৬. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইনে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে—এই আইনের ১০৫ ধারায় বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, ৯৮ ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আর গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করলে বা ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইনে।

আইনের ৬ ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৮ বছর, পেশাদারদের ক্ষেত্রে ২০ বছর। একই ধারার (গ) উপধারায় বলা হয়েছে, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস। অন্যদিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য ৯৮ ও ১০৫ ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের যোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে এই আইনের ৬ ধারায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে পেশাদার চালককে ৮ম শ্রেণি পাস ও বয়স ২১ বছর হতে হবে। এছাড়া অপেশাদার চালকের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সের বিধান রাখা হয়েছে।

আইনে বলা হয়েছে, হত্যার উদ্দেশ্যে গাড়ি চালানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা হবে। এই আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। এক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে দুর্ঘটনার প্রকৃতি। প্রতিবেদনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ পেলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা হবে। এই ধারায় শাস্তি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর তদন্ত প্রতিবেদনে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে হতাহতের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সড়ক পরিবহন আইনের ১০৩ ধারায় মামলা হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ৫ বছর জেল অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। অর্থদণ্ডের পরিমাণ আদালত নির্ধারণ করবেন।

পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইনের সব ধারায় মালিক শ্রমিকদের আপত্তি নাই। আইনের বিষয়ে শ্রমিকদের দাবি হচ্ছে—সড়ক পরিবহন আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের কারাদণ্ডের মেয়াদ ৫ বছরের বিধান বাতিল করতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির বদলে পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে। আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে সাইনবোর্ড রুটে চলাচলকারী রজনীগন্ধা পরিবহনের হেলপার আকবর হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন হেলপারি করার পর ড্রাইভার হওয়া আমাদের জীবনের একটি স্বপ্ন। কিন্তু এই আইনে আমরা কোনোদিন হেলপার থেকে চালক হতে পারবো না। কারণ যেকোনোভাবে ৫ম শ্রেণি পাস করতে পারলেও আমাদের পক্ষে ৮ম শ্রেণি পাস করা সম্ভব নয়। অথচ আইনে চালক হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস বাধ্যতামূলত করা হয়েছে। তাই হেলপার থেকে চালক হতে চাই, এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্তটি বাতিল করতে হবে।’

একইভাবে রাজধানীতে মতিঝিল থেকে গুলশান-বনানী রুটে চলাচলকারী ৬ নম্বর বাসের চালক ইলিয়াস আলী বলেন, ‘সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালানোর পরেও অনেক সময় রাস্তায় গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে, যখন মানুষ মারা যায়। এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা আমাদের প্রতি অবিচার। এ ধরনের মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী নই। তাই পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করতে হবে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘এই আইনের সব ধারাকে জানিযোগ্য করতে হবে। যে কোনও মামলা আমার নামে হতেই পারে। তবে জামিন পাওয়া আমার অধিকার। আদালত মনে করলে আমাকে জামিন দেবেন। কিন্তু আইনে সেই সুযোগ না থাকলে তা হবে অবিচার। তাই এই আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করার কথা বলেছি।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ সেক্টরে এখনও শিক্ষিত চালক বা হেলপার পাওয়া যায় না বিধায় আমরা চালক হেলপারদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি শিথিল করার সুপারিশ করেছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, ‘এখনও আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করা হয়নি। সড়ক পরিবহন আইনে শাস্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগটি ঠিক নয়। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নতুন আইনে সাজা কমানো হয়েছে। মোট কথা প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘নতুন আইনে সাজা বাড়ানো হয়নি, উল্টো কমানো হয়েছে।’ ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আগে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ (বি)-তে সাজা ছিল ৭ বছর। ১৯৮৫ সালে ৩ বছর করা হয়। এখন সাজা বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের আগের তুলনায় সাজা কমেছে।’

যদিও ২০১৪ সালের নভেম্বরে নিজের করা একটি মামলার বিপরীতে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে সাজা কমানোর বিষয়টি বাতিল করা হয় বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। সেই রায়টি আমলে নিলে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর বহালই আছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়টি ঠিক নয়।’

এদিকে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর টিআইবির পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে—‘পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের অযৌক্তিক দাবিদাওয়া ও চাপে সরকার যদি নতি স্বীকার করে, তা হবে আদালত অবমাননা ও জনস্বার্থ পরিপন্থী।’

এই প্রসঙ্গে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আইনটি সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান। এখনও এই কাজটি চূড়ান্ত করা হয়নি।’ কাজেই উদ্বেগের কিছু নেই বলেও তিনি মনে করেন।