মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ বাড়ছে

এ বছরের মে মাসের প্রথম দিকে হাওরে হঠাৎ বন্যার আশঙ্কা ছিল। ওই বন্যা আসেনি, বোরো ধানও নির্দিষ্ট সময়ে কাটা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ কালবৈশাখী, ভারী বৃষ্টি আর দাবদাহের মধ্য দিয়ে মাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এরপরই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান।

This May 17, 2020, satellite image released by NASA shows Cyclone Amphan over the Bay of Bengal in India. Amphan has intensified into a super cyclone and expected to make a landfall near Sundarbans, south of Kolkata, on Tuesday evening, May 19, 2020. A red alert has been initiated to sea bound fishermen and disaster management teams started evacuating villagers from the sea front. (NASA Worldview, Earth Observing System Data and Information System (EOSDIS) via AP)

তবে এবারের মে মাসেই প্রথমবারের মতো এমন আবহাওয়া পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা নয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশির ভাগই আঘাত হেনেছে এই মাসে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মে মাসের ঘূর্ণিঝড়গুলো মূলত দেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলে আঘাত হানে। আর নভেম্বরের ঝড়গুলো চট্টগ্রাম–নোয়াখালী উপকূলের দিকে বেশি যায়। ওই উপকূলের বড় অংশজুড়ে পাহাড় ও দ্বীপ আছে। আর দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চল উপকূল অপেক্ষাকৃত ঢালু বা নিচু। ফলে ঝড়–জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে সেখানে ক্ষতি হয় বেশি।

সর্বশেষ গত বুধবার সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সরকারের প্রাথমিক হিসাবে, আম্পানের আঘাতে দেশের ২৬টি জেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে আনুমানিক ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, ফসল নষ্ট হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির, প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২১ জন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আম্পানের আগে চলতি মাসে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকায় তিন থেকে আটটি করে কালবৈশাখী আঘাত হেনেছে। দেশের প্রায় ২০টি জেলায় বয়ে গেছে মৃদু দাবদাহ। ২৫টি জেলায় অল্প সময়ে বৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরে সংরক্ষিত ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে আঘাত হানা ঐতিহাসিক ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা ও পরের তিন বছরের ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে মোট ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ১৫টি এসেছে মে মাসে। আর গত এক যুগের (২০০৮-২০২০) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে মোট ৯টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এর মধ্যে ৭টিই হয়েছে মে মাসে। বাকি দুটির একটি জুলাইয়ে, অন্যটি নভেম্বর মাসে হয়েছে।

মে মাসের পরেই রয়েছে নভেম্বর মাস। এই মাসে ১৯৬০ সাল থেকে এ বছর পর্যন্ত ১০টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। একই সময়ে ডিসেম্বর মাসে তিনটি, এপ্রিল, জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে একটি করে ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের মাটিতে আছড়ে পড়েছে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে।

বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নভেম্বর ও এপ্রিল ঘিরে থাকে বিশেষ প্রস্তুতি। এখন মে মাসেও নজর দেওয়ার তাগিদ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয় নভেম্বর ও এপ্রিল মাসকে। এ জন্য নভেম্বর মাসকে ঘিরে বিশেষ প্রস্তুতি রাখা হয়। এ ছাড়া গুরুত্ব পায় এপ্রিল মাস। বাংলাদেশে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবসটিও মার্চ মাসে। অক্টোবর মাসে পালন করা হয় দুর্যোগ প্রশমন দিবস। কিন্তু এখন মে মাস নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার সময় এসেছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশ সাধারণত বন্যা মোকাবিলার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, প্রস্তুতিতেও ভালো করছে। ঘূর্ণিঝড় ২-৩ বছর পর পর আসত। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকেরা মিলে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতেন। আমাদের বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ অন্য অবাকাঠামোগুলো সেভাবেই প্রস্তুত রাখা হতো। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিবছরই মে মাসে বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত করছে। ফলে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টিকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং মে মাসকে গুরুত্ব দিতে হবে।

মে থেকে জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে দেশে হঠাৎ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আসছে উল্লেখ করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল বলেন, বছরের অন্যান্য সময়েও একটা না একটা দুর্যোগ লেগেই থাকছে। ফলে সারা বছরই দুর্যোগের প্রস্তুতির মধ্যে থাকতে হয়। তবে মে মাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা সরকার চিন্তা করছে বলে তিনি জানান।

মে মাসে কেন বাড়ছে

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে গত বছর সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস ছিল জুলাই। আর বাংলাদেশে বরাবরই সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস এপ্রিল ও মে। সূর্যের অবস্থানের কারণে রোদ বেশি পাওয়ায় ও বৃষ্টি কম হওয়ায় এমনটি হয়।

অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের তুলনায় গড়ে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর মধ্যে আবার মে মাসে হঠাৎ করে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার পর্যবেক্ষণেও একই ধরনের তথ্য এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ীও বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে আন্দামান সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আইপিসিসির বৈজ্ঞানিক প্যানেলের সদস্য এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি বাড়ছে মে মাসে। যে কারণে এই মাসে কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য প্রকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে। এই মাসের পরের তিন মাসজুড়ে বন্যার প্রবণতাও বাড়ছে। এসব দুর্যোগ উন্নয়নের যাত্রা ও জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। তাই মে মাসকে মাথায় রেখে দুর্যোগের বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হবে।