মেয়ের লাশ নিয়ে বাবার এ কেমন বিড়ম্বনা!

ট্রাকে করে গাজীপুর থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নে বাড়িতে ফিরছিলেন পোশাক শ্রমিক মৌসুমী আক্তার (২৫)। পথে তার মৃত্যু হলে লাশ ফেলে পালিয়ে যায় চালক ও তার সহকারী।

এরপর নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন বাবা গোলাম মোস্তফা। কিন্তু করোনায় মৃত্যু সন্দেহে মোবাইল ফোনে সেই লাশ এলাকায় না আনার হুমকি দেন বুড়িমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত।

নিরুপায় হয়ে বাবা গোলাম মোস্তফা এক লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের চালককে ৫ হাজার টাকা দেন মৌসুমীর লাশ দাফন করতে। তবে চালক সেই হতভাগ্য পিতার কাছে টাকা বুঝে নিলেও লাশ দাফন না করে ফেলে দেন তিস্তা নদীতে।

দুই দিন পর পানিতে ভাসতে থাকা ওই লাশ উদ্ধার করে আদিতমারী থানা পুলিশ। খবর পেয়ে গোলাম মোস্তফা ছুটে গিয়ে ফের শনাক্ত করেন মেয়ে মৌসুমীর লাশ।

আর কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘মারে আমি তোকে বাড়িতেই দাফন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চেয়ারম্যানের ভয়ে নিতে পারিনি!’

মেয়ের লাশের পাশে সন্তান হারানো পিতার এমন গগন বিদারী কান্নায় সোমবার দুপুরে ভারি হয়ে উঠে আদিতমারীর আকাশ-বাতাস!

হৃদয় বিদারক এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত আদিতমারী ও পাটগ্রাম থানা পুলিশের যৌথ উদ্যোগে নিজ গ্রামে দাফন করা হয় মৌসুমীর লাশ। কিন্তু কিছুতেই থামছে না পাগলপ্রায় বাবার কান্না। বারবার শুধু বিলাপ করে বলছেন, ‘যে চেয়ারম্যান মানুষের লাশ দাফনে বাঁধা দেয়, তার কি বিচার হবে না?’

পুলিশ ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, মৃত পোশাক শ্রমিক মৌসুমী আক্তারের বাড়ি পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম এলাকায়। মাত্র ৬ মাস আগে বাউড়া ইউনিয়নের সরকারের হাট এলাকার আবুল কালামের ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় মৌসুমী আক্তারের। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে একাই গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মৌসুমী। বৃহস্পতিবার অসুস্থতা অনুভব করলে একটি ট্রাক যোগে পাটগ্রামে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি।

পথিমধ্যে রংপুরের তাজহাট এলাকায় পৌঁছলে ট্রাক চালক তাকে মৃত দেখে লাশ ফেলে পালিয়ে যান। অজ্ঞাত হিসেবে তাজহাট থানা পুলিশ মৌসুমীর লাশ উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পরদিন শুক্রবার খবর পেয়ে তার বাবা গোলাম মোস্তফা সেখানে গিয়ে মেয়ের লাশ সনাক্ত করেন।

এরপর সেই মেয়ের লাশ বুঝে নিয়ে বুড়িমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাতকে মোবাইলে বিষয়টি অবগত করে নিজ এলাকায় দাফনের অনুমতি চান। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে চেয়ারম্যান তার পরিবার ও লাশবাহী গাড়ি গ্রামে ঢুকলে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন মৃতের বাবা গোলাম মোস্তফা।

নিরুপায় হয়ে হতভাগ্য গরিব বাবা মেয়ের লাশ দাফন করতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার একজন লাশবাহী গাড়ি চালকের সঙ্গে ৫ হাজার টাকা চুক্তি করেন লাশ দাফনের। চালক লাশ দাফনের আশ্বাস দিয়ে গোলাম মোস্তফাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। পরে লাশটি তিস্তা নদীতে ফেলে দেয়।

দুই দিন পরে স্থানীয়দের খবরে রোববার রাতে উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্দ্ধন গ্রামে তিস্তা নদী থেকে সরকারি ব্যাগে মোড়ানো অজ্ঞাত লাশটি উদ্ধার করে আদিতমারী থানা পুলিশ।

সোমবার ঈদের নামাজ শেষে আদিতমারী থানা পুলিশ জানাজা শেষে আদিতমারী কেন্দ্রীয় কবরস্থানে লাশটির দাফনের প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে পরিচয় শনাক্ত করেন মৃতের বাবা গোলাম মোস্তফা।

অবশেষে পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় আদিতমারী থানা পুলিশ এবং পাটগ্রাম থানা পুলিশের সহায়তায় পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়নের নিজ গ্রামে বিকালে মৌসুমীকে দাফন করা হয়।

এ নিয়ে কথা বলতে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাতের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আদিতমারী থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি সত্যিই খুব দুঃখজনক। মৃতের পরিচয় নিশ্চিত হবার পর তার বাবার অনুরোধে ও পুলিশ সুপারের নির্দেশে দুই থানা পুলিশের যৌথ উদ্যোগে লাশ তার গ্রামে দাফন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

সূত্র: যুগান্তর