মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদে চাকরির অভিযোগ, তদন্তে অভিযুক্ত ২ শিক্ষক

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকের চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিমোহন গভ. স্কুলের শিক্ষক মাহবুবুল হকের বিরুদ্ধে। তার বাড়ি বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের বাগবাড়ী গ্রামে। বাবার নাম জসিম উদ্দীন মণ্ডল।

এ বিষয়ে তদন্তের কপি একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।

২০০৭ সালে মাহবুবুল হক সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সমাজবিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেই থেকে তিনি হরিমোহন গভ. হাইস্কুলে আছেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটার সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি স্কুলের শিক্ষকরা জানতে পারেন মাহবুবুল হকের বাবা বেঁচে নেই এবং তার বাবা মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন না। একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দীন মণ্ডলের সনদ দেখিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেন। বাবার নাম এক হওয়ায় মাহবুবুল হক বিভিন্ন দিক ম্যানেজ করে এই কাজটি করতে সক্ষম হন। চাকরির পর তার সনদও যাচাই করা হয়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ডিইও) আব্দুর রশিদ বলেন,  রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের নির্দেশক্রমে সম্প্রতি তিনি অভিযোগটি বিশদে তদন্ত করেন। ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

আব্দুর রশিদ আরও বলেন, শিক্ষক মাহবুবুল হক মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন- তা প্রমাণ হয়েছে তদন্তে। এটা স্পষ্টত জালিয়াতি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ হয়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষ দেখবেন।

তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাহবুবুল হকের বাবার নাম জসিম উদ্দীন মণ্ডল ও মাতার নাম জামেনা বেগম। দুজনই বহু আগেই মারা গেছেন। মাহবুবুল হকের বাবা মৃত জসিম উদ্দীনের মণ্ডলের নাম জহির উদ্দিন সোনার। অন্যদিকে একই  গ্রামের প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দীন মণ্ডলের বাবার নাম মৃত মহির উদ্দিন মণ্ডল। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দীন মণ্ডলের স্ত্রীর নাম রোকেয়া বেগম। তারা উভয়ের জীবিত আছেন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিক্ষক মাহবুবুল হক কৌশলে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) বাবার নাম জসিম উদ্দীন মণ্ডল ও মাতার নাম রোকেয়া বেগম উল্লেখ করেছেন। অপরাধ ঢাকতে তিনি এনআইডিতে নিজের মৃত মা জামেনা বেগমের জায়গায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জীবিত রোকেয়া বেগমের নাম দিয়েছেন। তবে তদন্তকালে মাহবুবুল হক তার বাবা-মা বেঁচে আছেন বলে দাবি করেছেন।

যদিও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল হামিদের দেওয়া প্রত্যয়নপত্রে বলা হয়েছে শিক্ষক মাহবুবুল হকের বাবা-মা বেঁচে নেই। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দীন মণ্ডল বেঁচে আছেন। তবে মাহবুবুল হক নামে তার কোনো সন্তান নেই। একই তথ্য উল্লেখ করেছেন ছাতিয়ানগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হকও।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মাহবুবুল হক চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আবাসন ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীদের হাত করে চলেন। শিক্ষার্থী ভর্তি বাণিজ্য করেন। কোনো শিক্ষক তার এসব অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করলে তাদের নানাভাবে হেনস্তা করেন। হরিমোহন স্কুলের অনেক শিক্ষক মানসম্মানের ভয়ে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

মাহবুবুল হক কোচিং সেন্টার চালান। কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে বললে মাহবুবুল হক স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ পোস্ট দিয়ে তার সম্মানহানি করেন।

উল্লেখ্য, সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও মাহবুবুল হক চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে একটি বড় কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে লাখ লাখ টাকা কামাই করেন।

অন্যদিকে একই স্কুলের আরেক সহকারী শিক্ষক আব্দুর রহমানের বিষয়েও তদন্ত করেন জেলা শিক্ষা অফিসার। প্রতিবেদনে বলা হয় মাহবুবুল হকের মতোই শিক্ষক আব্দুর রহমানও নানা ধরনের অনৈতিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে জড়িত।

আব্দুর রহমান স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সামনে প্রকাশ্যে ধুমপান করেন। স্কুলের হোস্টেলে বসে শহরের বখাটের নিয়ে আড্ডা দেন। এছাড়াও নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া, পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র ইচ্ছেকৃতভাবে গায়েব করে দেওয়া ও অর্থের বিনিময়ে ভর্তি বাণিজ্য করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে।

এই দুই শিক্ষকের সাফাই বক্তব্যও তদন্ত প্রতিবেদনে সংযোজন করা হয়েছে। তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা মন্তব্যে লিখেছেন, অভিযুক্ত দুই শিক্ষক নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও তা প্রমাণক হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেওয়ায় মাহবুবুল হককে চাকরিচ্যুত করা ও অপর শিক্ষক আব্দুর রহমানকে দ্রুত অন্যত্র বদলির সুপারিশ করা হয়েছে।

অভিযুক্ত শিক্ষক মাহবুবুল হক ও আব্দুর রহমান নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

সূত্র:যুগান্তর