মাশরাফির নেতৃত্বে বদলে যাওয়ার দুই বছর

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সামগ্রিক আবহে চোখ বুলিয়ে দেখুন—অনুভূত হবে এক জিয়নকাঠির ছোঁয়া। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেই জিয়নকাঠির নাম ‘মাশরাফি বিন মুর্তজা’। ১৫ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মাশরাফি বল হাতে যেমন সফল, তেমনি সফল নেতৃত্বেও। আইসিসির ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ে টাইগারদের উত্তরণই যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তার নেতৃত্বেই টাইগাররা নবম স্থান থেকে উঠে এসেছে সপ্তম স্থানে। নেতা মাশরাফি যেন পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের চিত্রটা। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মঞ্চে ভীতি ছড়ানো দল! উপমহাদেশের পরাশক্তি ভারত-পাকিস্তান কিংবা ক্রিকেট দুনিয়ার অভিজাত অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা; কোনও দলই এখন আর বাংলাদেশকে ওয়ানডেতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার দুঃসাহস দেখায় না। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসলেই সমীহ করার সুর স্পষ্ট হয়ে উঠে তাদের কণ্ঠে। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এই সম্মান আদায় করে নিয়েছেন মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে। নেপথ্যে যার অনেকটা কৃতিত্ব অধিনায়ক মাশরাফির।

যদিও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজে ব্যাটসম্যানদের বাজে ব্যাটিংয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ হারতে হয়েছে টাইগারদের। তারপরও মাশরাফির অসাধারণ নেতৃত্বে অল্প পুঁজিতেও শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে লাল-সবুজরা। মাশরাফি আছেন বলেই গ্যালারিতে, টিভি সেটের সামনে অনেকেই আশায় বুক বাঁধেন, সাহস পান, শেষ বল পর্যন্ত জয়ের স্বপ্ন দেখেন।

দুই বছর আগে এই দিনে (৩০ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘দুই অধিনায়ক’ তত্ত্বের প্রয়োগ হয়েছিল। মুশফিকুর রহিমকে সরিয়ে ওয়ানডের নেতৃত্বে আনা হয় মাশরাফিকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে যা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মূলত মুশফিকের ওপর চাপ কমাতেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বোর্ডসভায় মাশরাফিকে ওয়ানডে দলের অধিনায়ক করার কঠিনতম সিদ্ধান্ত নেন। টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে মুশফিককেই বহাল রাখে বোর্ড। সেখানেই শুরু টাইগারদের নেতৃত্বে মাশরাফির ‘দ্বিতীয়’ ইনিংস। যদিও এর আগে এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নড়াইল এক্সপ্রেস।

.

মাশরাফির নেতৃত্বে বদলে যাওয়ার দুই বছর

২০১৪ সালে বাংলাদেশ যখন ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে খাদের কিনারায়, ঠিক তখনই বিসিবি দলের দায়িত্ব তুলে দেয় দেশসেরা পেসার মাশরাফির হাতে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে খেলোয়াড় মুশফিক-সাকিবের অবদান কখনোই মলিন হবে না; সম্মানের আসনে আজীবন থেকে যাবেন তারা। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে তারা দেশবাসীর মনে দাগ কাটতে সমর্থ হননি সেভাবে। কিন্তু দুই বছর আগে মাশরাফিকে ওয়ানডে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়ার পরই যেন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল দলের চিত্র! যে দলটা মাঠে ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না, মাশরাফির নেতৃত্বে সেই দলই এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ দলগুলোর কাছে রীতিমতো আতঙ্কের নাম।

২০১৪ সালে অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজ দিয়েই মূলত শুরু হয় তার মিশন। নতুন চ্যালেঞ্জে পুরোপুরি সফল তিনি। এখন অব্দি মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ ৬টি ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে। এর সবগুলোতেই জিতেছে বাংলাদেশ। এরপর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপেও মাশরাফির হাত ধরে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া ফেলে টাইগাররা। অনভ্যস্ত বাউন্সি কন্ডিশনে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয় বাংলাদেশ। মূলত অধিনায়ক মাশরাফিই দলকে গেঁথে ফেলেন এক সুঁতোয়।

বিশ্বকাপ থেকে ফিরেই পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। এত ধারাবাহিক সাফল্য বাংলাদেশের ক্রিকেটে আর কখনোই দেখা যায়নি।

.

গত বছর ভারত সফরে ভারতীয় এক সাংবাদিক তো মাশরাফির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কথার এক প্রসঙ্গে তিনি তো বলেই ফেললেন, ‘তোমাদের দলে এমন অধিনায়ক আছে যে কিনা হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে মাঠে খেলছে। তাকে দেখে তো তোমাদের বাকি ক্রিকেটাররা আরও প্রেরণা পাবে ভালো খেলার ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত, মাশরাফি যতদিন অধিনায়ক থাকবে ততদিন তোমারা পথ হারাবে না।’

দুই পায়ে অস্ত্রোপচারের ঝক্কিতে বারবার হোঁচট খেয়েছে মাশরাফির ক্যারিয়ার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এখনো স্বদর্পে খেলে যাচ্ছেন তিনি। এটাও এক বিস্ময়। এই বিস্ময় ছুঁয়ে গেছে তার অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডা. ডেভিড ইয়াংকেও। তাই তো গত বিশ্বকাপে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মাশরাফি খেলছে এটা ভাবাটাই এক বিস্ময়। তার ক্রিকেটের প্রতি প্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসাটাই তাকে খেলার সাহস যোগাচ্ছে।’

আফগানিস্তানের বিপক্ষে চলতি সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৭ রানের জয় পায় বাংলাদেশ। ওই ম্যাচটি জিতেই সব ফরম্যাটের ক্রিকেট মিলিয়ে মাশরাফি ছাড়িয়ে গেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনকে। মাশরাফি তিন ফরম্যাট মিলিয়ে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৫৩টি ম্যাচে। সেখানে তার জয় সংখ্যা ৩১টি। অন্যদিকে হাবিবুল টি-টোয়েন্টি বাদে বাকি দুই ফরম্যাটে ৮৭ ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে জয় পেয়েছেন ৩০টি ম্যাচে। হাবিবুলের চেয়ে কম ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েও জয়ের গড়টা মাশরাফিরই বেশি। শুধু তাই নয়, ওয়ানডে ক্রিকেটে নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়কদের মধ্যে সফলতার গড় সবচেয়ে ভালো মাশরাফির। ৩০ ম্যাচে ২১ জয়ে শতকরা ৭০ ভাগ ম্যাচে জিতেছেন অধিনায়ক মাশরাফি। যা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সাকিব আল হাসানের চেয়ে ২৩.০৭ ভাগ বেশি।

.

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পান মাশরাফি। এরপর ২০০৯ সালে অধিনায়কত্ব পেলেও ইনজুরির কারণে দল থেকেই ছিটকে পড়েন। ইনজুরির কষাঘাতে ঘরের মাঠে অনেক স্বপ্নসাধের ২০১১ বিশ্বকাপেও খেলা হয়নি তার। এরপর ২০১৪ সালে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর গোটা বাংলাদেশকেই বদলে দিয়েছেন মাশরাফি।

 

 

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন