মালিক-শ্রমিক মুখোমুখি, সারা দেশে লাগাতার ধর্মঘট

দাবি-দাওয়া নিয়ে দেশের নৌযান মালিক ও শ্রমিকরা (পণ্যবাহী যান) মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। দুই পক্ষের মধ্যে সঙ্কট সমাধানে সরকারও উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ধর্মঘট ডাকায় শ্রমিক ফেডারেশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করবে তারা।  আর শ্রমিকরা বলছেন, দাবি না মানা হলে ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন তারা।

খোরাকি ভাতাসহ ১১ দফা দাবিতে নৌ শ্রমিক (পণ্যবাহী যান) ধর্মঘটে সারা দেশে নদীপথে পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।  সমুদ্রবন্দরগুলোতে পণ্য খালাস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।  ঘাটে ঘাটে পণ্য নিয়ে অলস বসে রয়েছে লাইটার জাহাজ।  সোমবার মধ্যরাত থেকে পণ্য ও তেলবাহী নৌযানে লাগাতার এ ধর্মঘট শুরু করে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন।

এদিকে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানকে চিঠি দিয়েছে দি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যা ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম।

মঙ্গলবার এ চিঠি পাঠানো হয়।  এতে চেম্বার সভাপতি বলেন, ১৯ অক্টোবর রাত থেকে নৌযান শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন শুরু করেছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।  লাইটারেজ জাহাজ চলাচল না করায় সারা দেশে এসব কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বন্দরে জাহাজ জট এবং কনটেইনার জট সৃষ্টি হয়ে নতুনভাবে সঙ্কট তৈরি করবে।  জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম বৃদ্ধি এবং ওভার স্টে’র কারণে ডেমারেজ চার্জসহ পণ্য আমদানি-রফতানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।  ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং সাধারণ ভোক্তাদের অতিরিক্ত মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে হবে।

তিনি বলেন, বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাসের এই সময়ে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষ আরও চাপের মুখে পড়বে। অর্থনীতির গতিধারা পুনরুদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্যবসায়ীরা নতুন করে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।

চিঠিতে চেম্বার সভাপতি আরও উল্লেখ করেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ ধরনের ধর্মঘট অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকারক। এতে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে এবং সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যাবে।  ফলে বাজার অস্থিতিশীল হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাবে যা সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক উভয় পরিসরে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তবে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকদের চলমান ধর্মঘট নিরসনে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেই মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর।  সরকারের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিক সমঝোতার প্রস্তাব পায়নি দুই পক্ষ।  উল্টো ধর্মঘট নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।  এ ধর্মঘটকে অবৈধ ও উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থি বলে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।  কর্মসূচি প্রত্যাহার না করলে বুধবার থেকে ধর্মঘটী শ্রমিকদের বেতন দেয়া হবে না বলেও সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। তারা বলেছেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো চাপিয়ে দিলে মালিকেরাই জাহাজ চালাবেন না।

অপরদিকে ধর্মঘট ডাকা সংগঠন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা বলেছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।  কর্মসূচির পক্ষে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শ্রমিকদের মিছিল-কর্মী সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মধ্যে সমঝোতার অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।  কয়েকটি গ্রুপ অব কোম্পানির জাহাজের শ্রমিকদের দুই হাজার টাকা ভাতা দেয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। বাকি মালিকেরা একই পরিমাণ ভাতা দিতে রাজি হলেই বিআইডব্লিউটিএ বা শ্রম অধিদফতরে সব পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে।  তবে মালিকদের একটি পক্ষ জানিয়েছে, তারা শ্রমিকদের মাসে ন্যূনতম এক হাজার টাকা খোরাকি ভাতা দিতে রাজি আছেন।  এতে রাজি হচ্ছেন না কয়েকজন শ্রমিক নেতা।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক মো. আলমগীর কবির জানান, অন্যান্য দিনের মতো মঙ্গলবারও সদরঘাট থেকে যাত্রীবাহি সব রুটের লঞ্চ চলাচল করেছে।  ঢাকায় আসা ও ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের সংখ্যা কমেনি।  সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে।

১১ দফা দাবিতে সোমবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে ধর্মঘটে যায় বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। এর আগে সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন অধিদফতরের প্রধানেরা। মঙ্গলবার দুই সংস্থার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।  মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোও নিজ থেকে সঙ্কট সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

ধর্মঘট পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল হক বলেন, শ্রমিকদের ধর্মঘট আহ্বানের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।  তারা যে খোরাকি ভাতা দাবি করছে সেটির ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ধর্মঘট ডাকায় শ্রমিক ফেডারেশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করবেন বলেও জানান তিনি। এ ধর্মঘটের নেপথ্যে কালোহাত রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নূরুল হক বলেন, শ্রমিকদের দাবি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিলে জাহাজ চালানো সম্ভব হবে না।  আমরা জাহাজ চালাব না।  আমাদের জাহাজগুলো ট্রিপ পায় না।  আমাদের আয় নেই, ২-৩ মাস ধরে বেতন দিতে পারছি না। এরপরও খোরাকি ভাতা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েটি গ্রুপ অব কোম্পানি তাদের জাহাজের শ্রমিকদের ২ হাজার টাকা খোরাকি ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিতে পারে।  এটা তাদের ব্যাপার। তাদের জাহাজের সংখ্যা ৫শ’র বেশি নয়।  তারা নিয়ম লংঘন করে মাসে ৪-৫ ট্রিপ দেয়।  সাধারণ মালিকদের জাহাজের সংখ্যা দুই হাজার ৫শ’র বেশি। তারা এ ভাতা দিবে না।

সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন নেতারা। দাবিগুলো হচ্ছে- খাদ্যভাতার ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সব পক্ষকে মেনে চলতে হবে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নীতিমালা উপেক্ষা করে চলা জাহাজের শ্রমিকদের সার্টিফিকেট বাতিল করতে হবে। যেসব সন্ত্রাসী জাহাজ চালানোর কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি গেজেট অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগে শ্রমিক সংগঠনের অবৈধ দাবি-দাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নৌযান শ্রমিকদের সাহায্যে সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন বিহীন অবৈধ জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে হবে। সমুদ্র বহির্নোঙরে থেকে অবৈধ বাল্কহেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন বন্ধ করতে হবে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর