মার্কিন ভাড়াটে সেনার নেতৃত্বে একজন প্রেসিডেন্টকে ধরতে এক উদ্ভট ষড়যন্ত্র

তেসরা মে ২০২০, রোববার। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকার ঘোষণা করলো, তাদের সামরিক বাহিনী একটি সশস্ত্র আগ্রাসন প্রতিহত করেছে। অপারেশন গিডিওন নামের এই আক্রমণ ছিল সরকার উ‌ৎখাতের খুব আনাড়ি এক প্রচেষ্টা। শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এটি আসলে ব্যর্থ হতে চলেছে, এই অভিযানে যাওয়া মানে অনেকটা আত্মহত্যার সামিল। কিন্তু তারপরও কেন ভেনেজুয়েলার নির্বাসিত কিছু লোক এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্সেসের সাবেক কিছু সৈন্য এরকম এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল? দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে বিবিসির লিন্ডা প্রেসলির রিপোর্ট:

বিগত শতকে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা, অপহরণের নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। গত মে মাসের ঘটনা যেন অবিকল সেরকমই আরেক ষড়যন্ত্র।

উনিশশো একষট্টি সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সরকারকে উ‌ৎখাতের জন্য যে ব্যর্থ অভিযান চালানো হয়, সেটি ‘বে অব পিগস অভিযান’ নামে পরিচিত। পুরোপুরি মার্কিন অর্থ সহায়তায় এবং মদতে সেই অভিযানটি চালানো হয়েছিল। একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, গত মে মাসে অপারেশন গিডিওন নামের অভিযানটি এতটাই কাঁচা ছিল যে, তার তুলনায় কিউবায় বে অপ পিগস অপারেশনকে মনে হবে যেন ‘ডি ডে অভিযান‌'(দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত আচমকা আক্রমণের অংশ হিসেবে হাজার হাজার সৈন্যের ফ্রান্সের নর্মান্ডি উপকূলে অবতরণ)।

অপারেশন গিডিওন হচ্ছে ঔদ্ধত্য, আনাড়িপনা আর বিশ্বাসঘাতকতার এক বিস্ময়কর কাহিনী। ভেনেজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনী উপকূলীয় শহর মাকাটোতে আট জনকে গুলি করে হত্যা করে। আটক করে আরও কয়েক ডজন লোক। এরা এখন কারাকাসে জেলখানায় বন্দী। অল্প কজন পালিয়ে যেতে পেরেছিল। তখন সারা পৃথিবী ব্যস্ত ছিল করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে। তাই এই ঘটনা যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, গণমাধ্যমের ততটা মনোযোগ পায়নি লাতিন আমেরিকার বাইরে।

এই ব্যর্থ অভিযানের কেন্দ্রে ছিলেন মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেসের এক সাবেক সৈনিক জর্ডান গাউড্রু্।

জর্ডান গাউড্রু তিনবার ব্রোঞ্জ পদক জয়ী মার্কিন সেনা। যুদ্ধ করেছেন আফগানিস্তানে এবং ইরাকে। দক্ষ শ্যুটার। একই সঙ্গে প্রাথমিক জরুরী চিকিৎসা দেয়ার প্রশিক্ষণও তার আছে।

অপারেশন গিডিওন শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে তাকে গর্বের সঙ্গে বলতে শোনা যায়, “কলম্বিয়ার সীমান্ত থেকে আমরা এক দুঃসাহসিক উভচর অভিযান শুরু করেছি। আমাদের লোকজন একজন ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে। ভেনেজুয়েলার দক্ষিণে, পশ্চিমে এবং পূর্বে আমাদের ইউনিটগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।”

এই দাবির মধ্যে কোন সত্যতা ছিল না। ভেনেজুয়েলায় তাদের কিছু সমর্থককে হয়তো আভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের এই অভিযানে আসলে ছিল ষাট জনেরও কম পুরুষ আর একজন মাত্র নারী। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুবই কম। আর যখন এই দাবি তিনি করছেন, ততক্ষণে তাদের অভিযানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, শুরু হয়ে গেছে রক্তারক্তি।

জর্ডান গাউড্রু ২০১৮ সালে ‘সিলভারকর্প ইউএসএ’ নামে একটি বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। এটির ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গেলে দেখা যায় দুর্ধর্ষ সব সামরিক তৎপরতার ছবি। রানিং মেশিনের ওপর জর্ডান গাউড্রুর দৌড়ানোর ছবিও সেখানে আছে।

দু’হাজার উনিশ সালের ফেব্রুয়ারীতে তার কোম্পানিটিকে একটি কনসার্টের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এই কনসার্টটি হচ্ছিল কলম্বিয়ার ভেনেজুয়েলা সীমান্তে। কনসার্টটির স্পন্সর ছিল রিচার্ড ব্র্যানসন। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি তখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশটিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। খাদ্য সঙ্কটে মানুষ দিশেহারা। মৌলিক সেবা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে কলম্বিয়া চলে যাচ্ছে। কনসার্টটির উদ্দেশ্য ছিল ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে সেদেশে মানবিক ত্রাণ পাঠানো যায়।

জর্ডান গাউড্রু তখন তার কোম্পানির ইনস্টাগ্রাম একাউন্টে একটি ভিডিও আপলোড করে লেখেন, “ভেনেজুয়েলার সীমান্তে আমরা বিশৃঙ্খলা সামাল দিচ্ছি যখন কীনা এক স্বৈরশাসক শঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছে।” স্বৈরশাসক বলতে এখানে তিনি ইঙ্গিত করছিলেন নিকোলাস মাদুরোকে।

ভেনেজুয়েলার বহুধা বিভক্ত বিরোধী রাজনৈতিক শিবির তখন এক ভালো সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এই কনসার্টের আগে নিজেকে ভেনেজুয়েলার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেছেন বিরোধী নেতা হুয়ান গোয়াইদো। প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৫০টির বেশি দেশ হুয়ান গুয়াইদোর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন।

হুয়ান গুয়াইদো আশা করছিলেন, রিচার্ড ব্র্যানসনের স্পন্সর করা কনসার্ট যে ত্রাণ বহর পাঠানোর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিল, সেটি তাকে ক্ষমতায় বসাতে সাহায্য করবে। কিন্তু এই ত্রাণ বহর সীমান্তেই থামিয়ে দেয়া হয়। সেখানে সহিংসতা শুরু হয়। এপ্রিলের শেষে যে বিদ্রোহের চেষ্টা হয়েছিল, সেটাও বিফল হয়। কাজেই হুয়ান গুয়াইদোর সমর্থকরা তখন ছক কাটতে থাকেন, কিভাবে আচমকা সামরিক অভিযান চালিয়ে নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায়।

এজন্যে প্রথম প্রশিক্ষণ শিবিরটি স্থাপন করা হয় জুন মাসে কলম্বিয়ার মাইকাও শহরে।

ভেনেজুয়েলার পার্লামেন্টের এক নির্বাসিত সদস্য হারনান এইলম্যান গত মাসে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়ার আগে এই প্রশিক্ষণ শিবিরের বর্ণনা দিয়েছিলেন বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে।

“সেখানে লোকজন শারীরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, নানা ধরণের জ্ঞান অর্জন করছিল। কিন্তু আমাদের অনেক অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল। মাঝে মধ্যে আমরা দিনে মাত্র দু’বার খাবার দিতে পারতাম। আমরা যেখানে যখন সম্ভব চাঁদা তুলছিলাম। আমি আমার গাড়ি এবং অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিয়েছিলাম।”

এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে প্রচুর অর্থের দরকার ছিল। তখন সামনে এগিয়ে আসলেন জর্ডান গাউড্রু। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ততদিনে ভেনেজুয়েলার নির্বাসিত বিরোধী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছেন।

জুলাই মাসে কলম্বিয়া সফরে গেলেন জর্ডান গাউড্রু। সেখানে তার পরিচয় হলো জেনারেল ক্লাইভার আলকালার সঙ্গে, যিনি এই প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা। জেনারেল ক্লাইভার আলকালা প্রেসিডেন্ট মাদুরোর পূর্বসুরি ইউগো শ্যাভেজের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তখন তিনি দেশ থেকে পালিয়ে নির্বাসনে যান।

প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে সরাতে হাত মেলালেন এই দুজন।

হারনান এইলম্যান এই সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করছিলেন।

“আমরা আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বললাম। আমরা ভেনেজুয়েলার ক্ষমতার শীর্ষের কিছু ব্যক্তিকে একটা অভিযান চালিয়ে ধরে ফেলবো, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেব। তখন হুয়ান গুয়াইদো অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন, তারপর ভেনেজুয়েলায় নির্বাচন হবে।”

জর্ডান গাউড্রু বললেন, অর্থ জোগাড় করার দায়িত্ব তার। এর পরবর্তী বৈঠকগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে। এবারের বৈঠকে হুয়ান গুয়াইদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিশনের লোকজনও ছিল। এই কমিশনে কাজ ছিল কিভাবে প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেয়া যায়, গোপনে তার নানা উপায় খুঁজে বের করা।

“আমরা প্রায় ২২ ধরণের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলাম। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ পরিকল্পনাতেই ছিল শক্তি প্রয়োগের কথা,” বলছেন ভেনেজুয়েলার এক কট্টর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক কৌশলবিদ জে. জে. রেনডন।

“আমরা সিলভারকর্প ছাড়া আর কোন সামরিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলিনি। তবে আমরা তাদের যাচাই করে দেখেছি। এমনকি আমরা ফরেন লিজিয়নের কথাও ভেবে দেখেছি।”

জর্ডান গাউড্রু বলেছিলেন এরকম একটা সামরিক অভিযানের পেছনে অর্থ ঢালতে রাজী অনেক ব্যবসায়ী। তারা ভেবেছিল, প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে অপসারণের পর হুয়ান গুয়াইদো যখন ক্ষমতায় আসবেন, তখন তারা ব্যবসায়িক ফায়দা তুলতে পারবেন।

দু’হাজার উনিশ সালের ১৬ই অক্টোবর একটি চুক্তি সই করা হলো। এতে প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ধরা‌‌/আটক করা/ক্ষমতা থেকে সরানোর কথা বলা হয়। সেই সঙ্গে বর্তমান সরকারকে হটিয়ে তার জায়গায় হুয়ান গুয়াইদোকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট পদে বসানো। এই কাজের জন্য জর্ডান গাউড্রুকে শুরুতে দেয়া হবে দেড় মিলিয়ন বা পনের লাখ ডলার। কাজ শেষে পাবেন বিশ কোটি ডলার।

  এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যারা জানতেন, তারা ছিলেন উল্লসিত।

“বহু বছর ধরে আমরা ছিলাম একা। আমাদের লড়তে হচ্ছিল নিজেদের অর্থে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে আমরা কোন সমর্থন পাচ্ছিলাম না,” বলছিলেন ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল গার্ডের নির্বাসিত সাবেক ক্যাপ্টেন হাভিয়ের নিয়েতো। তার বিরুদ্ধে একবার ইউগো শ্যাভেজকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠে। এজন্যে তাকে জেলও খাটতে হয়।

“কিন্তু এবার আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। কারণ এই পরিকল্পনায় জে. জে. রেনডন, হুয়ান গোয়াইদো আর তার টিমের সমর্থন ছিল।”

কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বিবাদ শুরু হয়ে গেল। জর্ডান গাউড্রু তার পনের লাখ ডলার পাওনা দাবি করলেন। কমিশন তার আগে দেখতে চাইলো, যারা এই ষড়যন্ত্রে অর্থ জোগাবে, তারা কারা এবং এর প্রমাণ। কিন্তু জর্ডান গাউড্রু কোন প্রমাণ দেখাতে পারলেন না। মায়ামিতে জে. জে. রেনডনের সাগর তীরের এক বাড়িতে একটি বৈঠক শেষ হলো বেশ বাজেভাবে।

জে. জে. রেনডন জানান, জর্ডান গাউড্রুর মেজাজ খিঁচড়ে গেল, সে খুব অশ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করলো অন্যদের প্রতি।

“গত বছরের ৮ই নভেম্বর আমাদের শেষ বৈঠকটি ছিল বেশ অস্বস্তিকর। তখন আমি বললাম, আমাদের কোন কিছুই আসলে আগাচ্ছে না। আমি চাই তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যাও।”

মি. রেনডন বলছেন, এসব সত্ত্বেও তিনি জর্ডান গাউড্রুকে ৫০,০০০ ডলার দিলেন তার খরচ মেটানোর জন্য।

হুয়ান গুয়াইদোর প্রেসিডেনশিয়াল কমিশনের কাছে তখন জর্ডান গাউড্রুর সঙ্গে করা চুক্তিটির আর কোন মূল্য নেই। কিন্তু জর্ডান গাউড্রু তা মনে করে না। তারা তখন কলম্বিয়ায় তিনটি প্রশিক্ষণ শিবির চালাচ্ছে।

জর্ডান গাউড্রুর রিক্রুট করা মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেসের দু’জন সেনা এ বছরের জানুয়ারিতে কলম্বিয়ায় এসে পৌঁছালো। এদের একজন লুক ডেনম্যান। ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সামরিক বাহিনী ছেড়ে ড্রাইভারের কাজ করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক জীবন তিনি ছাড়তে পারলেন না।

ডেনম্যানের বোন সারাহ ব্লেক জানান, সামরিক বাহিনীর দিনগুলো খুব মিস করছিলেন লুক।

“আমার মনে হয় সে আসলেই সামরিক বাহিনীতে লোকজনের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ বন্ধন , সেটা খুব মিস করতো। কারণ ওরা একসঙ্গে থাকে, ঘুমায়, নিশ্বাস নেয়, নিজের জীবন দিয়ে একে অন্যকে বিশ্বাস করে। জর্ডান ছিল তার দলের জরুরী চিকিৎসা কর্মী। লুক এদেরকে তার ভাইয়ের মতো করে ভাবতো। খুবই বিশ্বাস করতো।”

“আমরা যেটা জানি, জর্ডান একদিন লুককে ফোন দিয়েছিল এবং বুঝিয়েছিল, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ তারা করতে যাচ্ছে। এই কাজ করতে পারলে ভেনেজুয়েলার মানুষের জীবন পাল্টে দেয়া সম্ভব হবে। লুক আমার বাবাকে ফোন করে জানিয়েছিল ও একটা চাকরি নিতে যাচ্ছে এবং এটা তার জীবনের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ একটি কাজ হতে যাচ্ছে।”

সারাহ ব্লেকের বিশ্বাস, তার ভাইকে জর্ডান গাউড্রু ভুল বুঝিয়েছিল।

লুক ডেনম্যান এখন কারাকাসের জেলখানায় বন্দী।

“ওরা আমার ভাইকে জানিয়েছিল এটি মার্কিন সরকারের মদতপুষ্ট একটি অভিযান।”

কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিল যে ভেনেজুয়েলানরা, তাদেরও বিশ্বাস ছিল যে মার্কিন সরকারের মদতে এই অভিযান চালানো হবে। অপর ভাড়াটে মার্কিন সেনা, আইরান বেরির বিশ্বাসও ছিল তাই।

কিন্তু আসলে এর কোন সত্যতা ছিল না।

চলতি বছরের মার্চ মাসেও এই অভিযানের জন্য কোন ভালো তহবিল পাওয়া গেল না। যদিও দুজন ভাড়াটে মার্কিন সেনা এই অভিযানে যুক্ত হয়েছে, ২০ জনের মতো ভেনেজুয়েলান তখন দল ছেড়ে চলে গেছে। কারও কারও প্রশিক্ষণ শিবিরের জীবন খুব কষ্টকর বলে মনে হচ্ছিল। কেউ কেউ সন্দেহ করছিল, এই পুরো পরিকল্পনার মধ্যে প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সমর্থকরাও ছদ্মবেশে ঢুকে গেছে। তখন সবকিছু ভন্ডুল হওয়ার উপক্রম হলো।

এরপর ২৩শে মার্চ কলম্বিয়ার কর্তৃপক্ষ একটা লরিভর্তি সামরিক সরঞ্জাম আটক করলো। এর মধ্যে অনেক অ্যাসল্ট রাইফেলও ছিল। তিনদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট ফর জাস্টিস জেনারেল ক্লাইভার আলকালার বিরুদ্ধে মাদক-সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনলো। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য এক কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হলো।

জেনারেল ক্লাইভার আলকালা আত্মসমর্পন করলেন। তবে এর আগে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি করলেন, ভেনেজুয়েলায় যেসব অস্ত্রশস্ত্র ধরা পড়েছে, সেগুলো ভেনেজুয়েলার মানুষের সম্পদ। তিনি আরও দাবি করলেন যে হুয়ান গুয়াইদো, জে. জে. রেনডন এবং মার্কিন উপদেষ্টাদের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, এই অস্ত্রের চালান তারই অংশ।

তবে হুয়ান গুয়াইদোর প্রেসিডেনশিয়াল কমিশন বললো, কথিত এই চুক্তি আর কার্যকর নেই।

হারনান এইলম্যান বিবিসিকে বলেন, তার মনে হলো এরমধ্যে কোন একটা ঘাপলা আছে। তার মতে, জেনারেল আলকালাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল যাতে তাদের অভিযানটিকে ব্যর্থ করে দেয়া যায়।

কয়েকটি সূত্রের মতে, বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং কলম্বিয়া – উভয় দেশের সরকারই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল, জেনারেল আলকালাকে সরিয়ে দেয়া হলে অন্যরাও প্রশিক্ষণ শিবির থেকে চলে যাবে। কিন্তু তারা আসলে যায়নি। আলকালা যখন চলে গেলেন, তখন তার জায়গায় অভিযানের দায়িত্ব নিলেন আন্তনিও সেকুই। তিনি ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল গার্ডের এক সাবেক ক্যাপ্টেন। ভেনেজুয়েলার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সংস্থার উচ্চপর্যায়ে একসময় কাজ করেছেন।

কিন্তু জর্ডান গাউড্রু কোথায় তখন ? তিনি তখন কলম্বিয়ায় নেই…

“২০২০ সালের ২৮শে মার্চ কিউরাকাউতে আমাদের রেসকিউ এন্ড কোঅর্ডিনেশন সেন্টারে সাহায্য চেয়ে একটি জরুরী বিপদ সংকেত আসলো একটি প্রমোদতরীতে থাকা কিছু লোকের কাছ থেকে। আমরা সাথে সাথে সেখানে একটি উড়োজাহাজ পাঠালাম”, বলছেন ডাচ-ক্যারিবিয়ান কোস্টগার্ডের একজন মুখপাত্র শ্যালিক ক্লিমেন্ট।

এই প্রমোদতরীর নাম সিলভারপয়েন্ট। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এটির মালিক ছিল জর্ডান গাউড্রোর কোম্পানি সিলভারকর্প ইউএসএ। তবে শেষ পর্যন্ত ডাচ ক্যারিবিয়ান কোস্টগার্ডের উড়োজাহাজের সাহায্য দরকার হয়নি তাদের। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামির কোস্টগার্ড সেটির কাছ দিয়ে যাওয়া একটি ট্যাংকারকে অনুরোধ করে ঐ প্রমোদতরী থেকে দুই মার্কিন নাগরিককে উদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসতে। এদের একজন কি জর্ডান গাউড্রু? সিলভারপয়েন্ট নামের প্রমোদতরীটিতে কি অস্ত্র বহন করে কলম্বিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল? মায়ামির কোস্টগার্ড এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, তারা বলেছে উত্তর দেবে এফবিআই। কিন্তু এফবিআই এসব প্রশ্নের উত্তরে কোন মন্তব্য করেনি। এই প্রমোদতরীটি কোথায় আছে, কেউ জানে না।

তবে আমরা যতদূর জানি, জর্ডান গাউড্রু কলম্বিয়ায় আর ফিরে যায়নি। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর তিনি মায়ামিতেই আটকে পড়েন। তবে জর্ডান গাউড্রু যদি সেই প্রমোদতরীর দুই আমেরিকানের একজন হতেন, তাহলো হয়তো অপারেশন গিডিওনের সেদিনই মৃত্যুঘণ্টা বেজে যেত। এর কারণ এই নয় যে এই সাবেক সৈনিক, যিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করতেন, তিনি আর তার সৈনিকদের আর নেতৃত্বে দিতে পারতেন না। কারণটা ছিল ভিন্ন। ভেনেজুয়েলায় তখন যেন একটা বিরাট বোমা ফেটেছে, ফাঁস হয়ে গেছে এই ষড়যন্ত্রের বৃত্তান্ত।

ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট মাদুরোর পর দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি মনে করা হয় যাকে, সেই ডিওসডাডো ক্যাবেলো ২৮শে মার্চ তার নিজের সাপ্তাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ভয়ংকর কিছু তথ্য ফাঁস করলেন। কলম্বিয়ায় নির্বাসিত ভেনেজুয়েলানদের ক্যাম্পগুলোর কিছু তথ্য তুলে ধরলেন, সেখানে ছিল ষড়যন্ত্রে যুক্ত তিন আমেরিকানের নাম।

পুরো ষড়যন্ত্রটি উন্মোচিত হয়ে গেল।

তবে ততদিনে এই ক্যাম্পগুলোতে যেসব লোক ছিলেন, তারা সেখান থেকে অন্যত্র সরে গেছেন। তারা একটি প্রত্যন্ত উপকূলীয় এলাকা গুয়াজিরে এমন এক জায়গায় গেলেন, যার সঙ্গে আছে ভেনেজুয়েলার সীমান্ত।

নিকোলাস মাদুরোর সরকার যে এই ষড়যন্ত্রের কথা জেনে গেছে, সেটা কি তারা টের পেয়েছিলেন? ভেনেজুয়েলার লোকজন নিজেদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে। তবে এই ক্যাম্পে কেবল দায়িত্বে থাকা লোকদের কাছেই মোবাইল ফোন ছিল। একটি সূত্র বলছে, অধিনায়ক আন্তনিও সেকুই জানতেন ক্যাবেলোর টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সব ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। নিকোলাস মাদুরোর সরকারের মন্ত্রীরা এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছিলেন, সেসবও তিনি জানতেন। তবে এরপরও এই বলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে তার সমর্থকদের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলেন যে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে।

এই অভিযান যে এখন বানচাল হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, সেটা জর্ডান গাউড্রু কি জানতেন? সেটা স্পষ্ট নয়। তিন আমেরিকানের একজনও স্প্যানিশ ভাষা জানতো না। একটি সূত্র বলছে, কলম্বিয়ায় লুক ডেনম্যান এবং আইরান বেরির কাছে একটি স্যাটেলাইট ফোন ছিল। তারা গাউড্রুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। জর্ডান গাউড্রু তাদের বলতো, আরও অনেক সাবেক মার্কিন সেনা এই অভিযানে অংশ নিতে আসবে।

আর জর্ডান গাউড্রু যদি সত্যিই জেনে গিয়ে থাকে যে নিকোলাস মাদুরোর সরকার তাদের ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে গেছে, হয়তো সেটি তিনি তার বন্ধুদের বলেননি। সূত্র বলছে, আর্থিক সঙ্কটের কারণে তার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত ছিল। কলম্বিয়ায় যে অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়ে গিয়েছিল, সেটির জন্য তখনো তার ৩০,০০০ ডলার দেনা ছিল। এপ্রিলের শেষে তার আইনজীবীরা হুয়ান গুয়াইদোর কমিশনের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ১৫ লাখ ডলার ফি পরিশোধের দাবি জানায়।

ঘটনা যেরকমই হোক, ‘অপারেশন গিডিওনে’র বিস্তারিত যে নিকোলাস মাদুরোর সরকারের হাতে পৌঁছে গেছে, সেটা বিদ্রোহীরা জানুক বা না জানুক, এই অভিযানটি যে একেবারেই লাগামহীন তা স্পষ্ট। অভিযানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু সূত্রের মতে, বিদ্রোহীরা উভচর তরীতে করে ভেনেজুয়েলার উপকূলে গিয়ে নামার পর কয়েকদিন কিছু গোপন আস্তানায় থাকার কথা ছিল। এরপর তারা রাজধানী কারাকাসের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা। রাজধানীতেও তারা কয়েকদিন ঘাপটি মেরে থাকবে। এরপর লক্ষ্যে হামলা চালাবে। তাদের টার্গেট: প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, সামরিক বন্দীশালা এবং ভেনেজুয়েলার গোয়েন্দা সংস্থার সদর দফতর। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং তার ঘনিষ্ঠ শীর্ষ ব্যক্তিদের আটক করা তাদের লক্ষ্য।

এখানে ভুল হওয়ার কোন কি সুযোগ আছে? দেখা গেল, সব হিসেব-নিকেশই আসলে ভুল ছিল।

শুক্রবার, ১লা মে সন্ধ্যে ছয়টায় ১১ জনকে বহনকারী একটি নৌকা কলম্বিয়ার উপকূল থেকে ভেনেজুয়েলার দিকে যাত্রা শুরু করলো। তাদের কাছে ছিল আটটি রাইফেল। দশ মিনিট পর দ্বিতীয় একটি নৌকা ছাড়লো। এটিতে ছিল ৪৭ জন। আর ছিল দুটি রাইফেল। ক্যারিবিয়ান সাগর ধরে এক ঘন্টা চলার পরই একটি নৌকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। অথচ তখনো বহু ঘণ্টার পথ বাকী। সমূদ্র অশান্ত। অনেকে এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে গেছে।

ভেনেজুয়েলার উপকূলীয় শহর মাকাটোতে তখন নিকোলাস মাদুরোর সশস্ত্র বাহিনী অপেক্ষা আছে। ৩রা মে, রোববার ভোরে যখন আটজনকে বহনকারী একটি নৌকা সেখানে পৌঁছালো, তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ পরিণতি।

দ্বিতীয় নৌকাটি ছিল অনেক পেছনে। তখন এটির জ্বালানি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বেশিরভাগ লোককে তীরে নামিয়ে দেয়া হবে যাতে তারা পালাতে পারে। অধিনায়ক আন্তনিও সেকুই, দুই আমেরিকান এবং অন্য কজন নৌকায় থেকে গেল। তারা শীঘ্রই ধরা পড়লো।

কিছু কিছু ভাষ্যকার অপারেশন গিডিওনের নাম দিয়েছেন ‌’বে অব পিগলেটস’। অন্যরা একে স্রেফ ‘পাগলামি’ বা ‘উদ্ভট’ বলে বর্ণনা করেছেন। হাভিয়ের নিয়েতো, যিনি কীনা একজন সাবেক সৈনিক, কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন এরকম একটি উদ্ভট পরিকল্পনা, যেখানে মৃত্যু বা ধরা পড়ার সম্ভাবনা একেবারে নিশ্চিত?

“ওরা হয়তো কিছু একটা করার চেষ্টা করে মরতে চেয়েছিল। ওরা যদি কলম্বিয়ায় থাকতো, সেখানে কোন কাজ পেত না, তাদের বাঁচার জন্য কোন টাকা ছিল না। কাজেই তাদের হয় কোন গেরিলা গোষ্ঠীতে যোগ দিতে হতো বা কোন মাদক পাচারকারীর দলে”, বলছেন তিনি।

“এটা শুনতে পাগলামি মনে হবে। কিন্তু এরকম একটা হতাশাজনক পরিস্থিতিতে বেশিরভাগই হয়তো ভেবেছে আমি কলম্বিয়ায় এরকম কোন দলে যোগ দেয়ার চাইতে বরং ভেনেজুয়েলার জেল থাকবো।”

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্সেসের দুজন উচ্চ প্রশিক্ষিত সৈনিক কেন এই একই কাজ করবেন, যে দেশটি তাদের নয়, সেরকম একটি দেশ ‘মুক্ত’ করতে নৌকায় উঠবেন, সেটার ব্যাখ্যা কী? সূত্র: বিবিসি বাংলা