পুরাতন বছর

মহামারি নিয়ে এসেছিল আরেক মহামারি

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

টানা দুই বছর। এশিয়া থেকে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে সমানে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারি; যা ইতোমধ্যে অর্ধকোটিরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু শুধু করোনাই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রকট হয়ে উঠেছে আরও একটা মহামারি। বৈষম্যের মহামারি। করোনার দোর্দণ্ড দাপটের আড়ালে নীরবে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক বৈষম্য ও অসমতা। ধনী আরও ধনী হয়েছে।

আরও দুর্বল হয়েছে গরিব। এক দিকে লাখ লাখ টিকা নষ্ট হচ্ছে। অন্য দিকে কেউ চেয়েও পাচ্ছে না। আয় অসমতা থেকে শিক্ষা-চিকিৎসা বঞ্চনা কোটি কোটি মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হয় এক ‘অজানা’ ভাইরাস। তখন মানুষ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি ভাইরাসটি পুরো পৃথিবীকে ওলটপালট করে দেবে। শুরুর দিকে এটাকে ততটা গুরুত্বই দেয়নি বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সংক্রমণ ও মৃত্যু। অবস্থাদৃষ্টে ৩০ জানুয়ারি একে মহামারি ঘোষণা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আজ ৩১ ডিসেম্বর প্রথম করোনা সংক্রমণের দুই বছর পূর্ণ হলো। করোনা টিকার সুবাদে ২০২০ সালের শেষ দিকে সংক্রমণ কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু এরপর আবার শক্তিশালী হয়ে ২০২১ সাল বছরজুড়েই তাণ্ডব চালিয়েছে।

ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য মতে, এই দুই বছরে বিশ্বের এমন কোনো দেশ-ভূখণ্ড নেই যেখানে হানা দেয়নি এই ভাইরাস। এখন পর্যন্ত শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে আটাশ কোটি মানুষ। মৃত্যু হয়েছে ৫৪ লক্ষাধিক মানুষের। বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু করোনা মহামারিই নয়, করোনার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অসমতা ও বৈষম্য। বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে অসমতার মহামারি চলছে। সংস্থাটির এক রিপোর্ট মতে, করোনার কারণে দেশে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন থমকে গেছে। ‘চরম দারিদ্র্য’ ও বৈষম্য অবসানের প্রচেষ্টায় বাদ সেধেছে।

করোনার কারণে ২০২০ সালে ‘চরম দারিদ্র্যে’র হার (কোনো লোক ১.৯০ ডলারের নিচে আয় করলে তাকে চরম দরিদ্র বলা হয়) বেড়েছে এবং নতুন করে গরিব হয়েছে প্রায় ১০ কোটি মানুষ। সারা পৃথিবীতেই অসমতা যে ব্যাপক হারে বেড়েছে তা ইতোমধ্যে নানা রিপোর্টে উঠে এসেছে। আয়, সম্পদ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা-সব খাতেই এই অসমতা দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারিতে ১৯৩০ সালের পর বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এই সংকটের মধ্যেও মানুষকে স্বাস্থ্য খাতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে বহু মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট বলছে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের কারণে বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা খ্রিষ্টান এইডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক অসমতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রকৃত অবস্থার সত্যিকার চিত্র উঠে আসেনি। এই অসমতা বিশ্বকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। ‘ব্লিডিং ব্যাক উইথ জাস্টিস : ডিসমান্টলিং ইনইকুয়ালিটি আফটার কোডিভ-১৯’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি ২০২১ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, চাকরি হারানো ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মারাত্মক আকার নেওয়ায় গরিব দেশগুলোতে সংকট বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে রূপ নিচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবগুলো কেবল পড়তে শুরু করেছে। অন্য দিকে ধনীদের সম্পদ আরও বেড়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের তৈরি ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট বা বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদন তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে বিশ্বের মোট আয়ের ৫২ শতাংশই কুক্ষিগত হয়েছে পৃথিবীর শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী মানুষের হাতে।

আর মধ্যম আয়ের বৈশ্বিক ৪০ শতাংশ মানুষের হাতে গেছে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ আয়। এ ছাড়া নিু আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে গেছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ বৈশ্বিক আয়। মহামারিকালে টিকার বৈষম্যের চিত্র প্রকট আকারে সামনে এসেছে। কোনো কোনো দেশে নাগরিকদের দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন হওয়ার পর তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো দেশে চেয়েও পাচ্ছে না মানুষ। ব্যবহারের অভাবে বহু টিকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।-সূত্র : যুগান্তর