ভোক্তা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে ক্যাব

খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার অভাবে চরম হুমকির মুখে রয়েছে ভোক্তা স্বাস্থ্য। ট্রান্স ফ্যাট মানুষের হৃদরোগ ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এমতাবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করার দাবি জানিয়ে আজ ৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে রাজশাহী জেলা প্রশাশকের কার্যালয়ের সেমিনার কক্ষে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), ‘খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট, হ্নদরোগের ঝুঁকি এবং করনীয়ঃ ভোক্তা পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক বিভাগীয় সেমিনার ও আলোচনা সভা আয়োজন করে।

এসময় সভায় উপস্থিত প্রধান অতিথি  জেলা প্রশাসক,রাজশাহী জনাব আব্দুল জলিল বলেন, “সরকার জনগণের কল্যাণেই আইন প্রণয়ন করে, এবং এই আইনকে যুগোপযোগী করার জন্য সচেষ্ট আছে। ট্রান্সফ্যাট স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ – এবিষয়ে জনগণকে আরও সচেতন করার ক্যাবের এই উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী সফল করার জন্য আহ্বান করছি। জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে আরও এগিয়ে আসতে হবে।”

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন মোঃ খায়রুল ইসলাম পরিচালক, বিএসটিআই রাজশাহী; অপূর্ব অধিকারী উপ-পরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, রাজশাহী  এবং ডাঃ মোঃ খুরশিদুল ইসলাম।

সহকারী জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাজশাহী শরিফুল হক এর সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন লিয়াকত আলী সম্পাদক, দৈনিক সোনালী সংবাদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আব্দুল মান্নান সাবেক মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার মহানগর, এড. মস্তাফিজুর রহমান খান সভাপতি সার্ক লিংক পিপলস ফোরাম, জামাত খান সাধারণ সম্পাদক রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ, ইঞ্জিনিয়ার খালেদ চৌধুরী পাইম, রিয়াজ আহমেদ সভাপতি রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি, মাহমুদুল আলম মাসুদ যুগ্ম সম্পাদক ক্যাব রাজশাহী, অ্যাড. শামসুন্নাহার মুক্তি ও নাজমুল ইসলাম সভাপতি ক্যাব পবা উপজেলা, প্রমুখ। ক‍্যাব রাজশাহী শাখার সভাপতি কাজী গিয়াস এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সার্বিক পরিচালনা করেন মোঃ গোলাম মোস্তফা মামুন সাধারণ সম্পাদক, ক্যাব রাজশাহী এবং আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন, ক্যাবের প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর খন্দকার তৌফিক আলহোসাইনী এবং প্রজ্ঞা’র ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর।

আলোচনা সভায় সহায়তা করেছে গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এবং সার্বিক সহযোগিতা করেছে সম্মিলিতভাবে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং  গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)।

সেমিনারে জানানো হয়, খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস হচ্ছে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও), যা ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত। ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো জমে যায়, এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়। এই শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (dementia) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (cognitive impairment) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫,৭৭৬ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ি ট্রান্সফ্যাট। ডব্লিউএইচও প্রকাশিত “WHO REPORT ON GLOBAL TRANS FAT ELIMINATION 2020” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে ১৫টি দেশে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অতিসম্প্রতি, ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) ব্র্যান্ডসমূহের নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর গবেষকগণ। গবেষণায় ঢাকার পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও এর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা না থাকায় মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। এমতাবস্থায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করার দাবি জানায় ক্যাব। পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে মোড়কজাত খাবারের পুষ্টিতথ্য তালিকায় ট্রান্সফ্যাটের সীমা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, উপকরণ তালিকায় পিএইচও এর মাত্রা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, ফ্রন্ট অব প্যাকেজ লেবেলস বাধ্যতামূলক করা যা খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি নির্দেশ করবে, এবং “ট্রান্সফ্যাট-মুক্ত” বা “স্বল্পমাত্রার ট্রান্সফ্যাট” এ জাতীয় স্বাস্থ্যবার্তা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে খাদ্যপণ্যের উপাদান সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায় বলে কর্মশালায় জানানো হয়।