ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি: সরকারের ওভার ট্রাম্প ঠেকাতে সতর্ক বিএনপি 

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই নতুন উত্তাপ। আর এ উত্তাপ ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের এ তৎপরতা আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলছে বলে ধরে নিয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ হুমকি ঘুম হারাম করেছে বিরোধীদের।

একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষই প্রচার করছে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নয় তারা। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর দাবি- ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনসহ বর্তমান সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই নির্বাচনের প্রায় ৭ মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তবে এখানে বিরোধী দলগুলোকে মাঠের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে সহিংসতা পরিহার করতে হবে। যাতে সরকার এটা প্রমাণ করতে না পারে যে, বিরোধী দলগুলোর সহিংসতা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান বাধা।

অন্যদিকে যারা নির্বাচনে বাধা দেয় তাদের বিরুদ্ধে এ ভিসানীতি কার্যকর হয় কি না সেটা দেখার বিষয় বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

মার্কিন এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। তবে এই বিষয়ে আলোচনায় রয়েছেন আরও এক ব্যক্তি। তিনি হলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সেই ডোনাল্ড লুও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেছেন- নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা করলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও মার্কিন ভিসা পাবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ করার দায়ে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল- নাইজেরিয়া, উগান্ডা, বেলারুশ, নিকারুগুয়া, সোমালিয়া।

আর বিএনপির নেতারা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার দায়িত্ব যেহেতু সরকারের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে বিরোধী দলগুলোর চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করার ৯০ শতাংশ দায় সরকারের। বিরোধী দলগুলো শুধু সহযোগিতা করতে পারে। আর এই সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও সমাধানযোগ্য পথ হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

দলটির নেতারা আরও বলছেন, বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমাদের কোনো ভয় নেই। তবে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে কর্মসূচি প্রণয়নে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি কোনো দল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। তাই আগামীতে আরও সতর্কভাবে কর্মসূচি পালন করতে হবে যাতে সহিংসতা এড়ানো যায়। এক্ষেত্রে, সরকার যদি বিএনপির দাবি মেনে না নেয়, তাহলে আগামীতে কর্মসূচির ধরনে পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক। তখন যদি কোনো সহিংস পরিবেশ তৈরি হয়, তার জন্য সরকারকে বেশি দায় নিতে হবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এই সরকারের আমলে নির্বাচনগুলো যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাদের অধীনে আগামীতেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- সেটা কূটনৈতিক ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র বুঝিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গত ২ বছর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আমরা প্রমাণ করেছি বিএনপি সহিংসতা চায় না। আর এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আমরা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কটূক্তিও শুনেছি, এদের শক্তি নেই। আমাদের অনেক নেতাকর্মীও মারা গেছে। তারপরও আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। এখন সরকার যদি বাধ্য করে সহিংস রাজনীতি করতে তার দায়-দায়িত্ব তাদের নিতে হবে।

মোহাম্মদ শাহজাহান আরও বলেন, বিএনপি ধৈর্য্য সহকারে কর্মসূচি পালন করছে। আমরা সহিংসতা চায় না। কিন্তু সরকার যদি হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার করে করে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেয়, তখন কোনো সহিংসতা হলে এটার দায় সরকারকে নিতে হবে। তবে, আমরা আশা করি, সব মহলের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, জামায়াতের কারণে এক সময় আওয়ামী লীগ বিএনপিকে স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিতো কূটনীতিকদের কাছে। এখন তারা সেটা পারছে না। এই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিকেও বিদেশিদের কাছে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেটা থেকে এখন আমরা মুক্ত। এখন কোনো উসকানিতে পা দেওয়া যাবে না।

গত বছর থেকে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে গণতন্ত্র মঞ্চ। এই জোটের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ‘লজ্জাজনক’ মনে করলেও সরকারকে দাবি মানাতে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন তারা।

মঞ্চের নেতারা আরও বলছেন, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিতে নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারির পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের চেয়ে অনেক সহনশীল হয়েছে। এটা বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের জন্য ইতিবাচক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগামীতেও তাদের এই সহনশীল মনোভাব ধরে রাখলে এবং বিরোধী দলগুলো আরও সচেতন হলে কর্মসূচি কেন্দ্রীয় সহিংসতা পুরোপরি এড়ানো না গেলেও অনেকাংশে সম্ভব। তাহলে  ভিসানীতির যে নিষেধাজ্ঞা সেটা এড়াতে পারবে বিরোধী দলগুলো।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। যারা সরকারের হুকুম পালন করতে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে গেছে, সেখানে তারা লাগাম টেনে ধরবে বলে মনে করি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের প্রয়োজনে কিছুটা হলেও সহনশীল হতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পেশাদারিত্বে সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে সেটা আন্দোলনের জন্য ইতিবাচক হবে। সরকার চাইলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে মনে করি না। আর আমরা তো বরাবরের মতো সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ধরে রাখতে চায়। এটা আমাদের দুর্বলতা নয়। আমরা চাই সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে বেশি করে যুক্ত করতে।

যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র 

চলতি বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনকে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাধাগ্রস্ত করবে বা গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ জারি করবে যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নতুন এই নীতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে- ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের ভাষায়- ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমসহ সবার। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সকলকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’

যা বলছে সরকার 
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল জাতি, যেখানে দেশটির জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে এটা স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অব্যাহত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে দেশের জনগণ অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের একটি আন্তর্জাতিক রোল মডেল। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার কারণে এটি অর্জন হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। ভোট কারচুপির মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট কেড়ে নিয়ে কোনো সরকারের ক্ষমতায় থাকার নজির নেই। জনগণের ভোটের অধিকারকে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় পবিত্রতা বলে মনে করে। আর এই অধিকারের জন্য নিরলস সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের রাজনৈতিক ইতিহাস তার রয়েছে।

সরকার সব শান্তিপূর্ণ ও বৈধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সভা-সমাবেশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শমূলক পদ্ধতিতে চলে থাকে।

বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলা হয়, কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দেশে উন্নয়নের অর্জনকে টিকিয়ে রাখা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর টেকসই অঙ্গীকারের পাশে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে বলে সরকার প্রশংসা করে।