ভারতের পোশাক বিজ্ঞাপন নিয়ে বিতর্ক, কী ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা?

ভারতের একটি নামী পোশাক ব্র্যান্ড ফ্যাবইন্ডিয়া তাদের বিজ্ঞাপনে দিওয়ালি উৎসবকে একটি উর্দু শব্দবন্ধ দিয়ে বর্ণনা করার পর তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে সেটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে।

ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন, ফ্যাবইন্ডিয়া যেভাবে দিওয়ালিকে উর্দুতে ‘জশন্-ই-রিওয়াজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে তাতে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগ আহত হয়েছে। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।

ফেসবুক বা টুইটারেও অনেকেই ফ্যাবইন্ডিয়ার এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে ওই ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দিয়েছেন।

সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু মানুষ অবশ্য একে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাড়াবাড়ি হিসেবেই দেখতে চান।

বস্তুত, ফ্যাবইন্ডিয়া ভারতে ৬০ বছরেরও বেশি পুরনো একটি নামী ব্র্যান্ড, যার সূচনা হয়েছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশনের হয়ে ভারতে কাজ করতে আসা মার্কিন নাগরিক জন বিসেলের হাত ধরে।

এখন এদেশে প্রায় ৪০ হাজার হস্তশিল্পী ও তাঁতি-বুননকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে এই ব্র্যান্ডটি – এবং তাদের বস্ত্রসম্ভার বিক্রি হয় অনলাইনে ও বড় বড় সব শহরের অজস্র বিপণি থেকে।

কিন্তু আসন্ন দিওয়ালি উৎসব উপলক্ষে ফ্যাবইন্ডিয়া এ মাসের শুরুর দিকে যে নতুন কালেকশন লঞ্চ করেছে, তার বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করেই দেখা দিয়েছিল নতুন বিতর্ক।

সেই বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইনে ফ্যাবইন্ডিয়া দিওয়ালিকে বর্ণনা করেছিল ‘জশন্-ই-রিওয়াজ’ বা রীতি-পরম্পরার উৎসব হিসেবে। কিন্তু হিন্দুদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবকে কেন মূলত মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত উর্দু ভাষায় বর্ণনা করা হবে, তা নিয়েই আপত্তি তুলতে থাকেন অনেকে।

বিজেপির এমপি ও দলের যুব শাখার সভাপতি তেজস্বী সূরিয়া টুইট করেন, ‘দিওয়ালি কখনোই জশন্ ই রিওয়াজ নয়। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবগুলোকে যেভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে আব্রাহামিকরণ করা হচ্ছে, মডেলদের সাবেক হিন্দু পোশাকেও দেখানো হচ্ছে না – তার প্রতিবাদ করতেই হবে।’

ফ্যাবইন্ডিয়াকে এই ‘মিসঅ্যাডভেঞ্চারে’র মাশুল চোকাতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র বিনোদ বনসলও বলেন, ‘যে ধরনের শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করে ফ্যাবইন্ডিয়া হিন্দুদের একটি পবিত্র উৎসবকে বর্ণনা করেছে তাতে হিন্দুধর্মকে অপমান করা হয়েছে। দিওয়ালিতে লক্ষ্মী-গণেশ সহ হিন্দু দেব-দেবীদের আমরা পুজো করে থাকি, ঋদ্ধি-সিদ্ধির কামনা করি – এটাকে কী করে রিওয়াজ বলা হচ্ছে?’

সোমবার সন্ধ্যায়ও ভারতে টুইটারে সর্বাধিক ট্রেন্ডিং টপিকগুলোর মধ্যে একটি ছিল হ্যাশট্যাগ বয়কটফ্যাবইন্ডিয়া।

এমন কী আজ সকালেও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে তুমুল আলোচনায় ছিল ‘উর্দু’ নিয়ে।

ইউটিউবার নমন শর্মা বলেন, “জশন্-ই-রিওয়াজ শুনলেই মনে হয় ঈদ বা রমজানের কথা বলা হচ্ছে – এবং হিন্দুদের কোনও ধর্মীয় উৎসব এলেই তার বিরুদ্ধে দেখি সব সময় এভাবে প্রোপাগান্ডা চালোনো হতে থাকে।”

গত বছর দিওয়ালির সময় ‘তানিস্ক’ নামে ভারতের একটি জুয়েলারি ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তথাকথিত লাভ জিহাদ বা হিন্দু-মুসলিম বিয়েকে প্রোমোট করা হচ্ছে – সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।

ভারতের অ্যাডভার্টাইজিং জগতের দিকপাল দিলীপ চেরিয়ান অবশ্য মনে করেন, “সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে একটি ব্র্যান্ডের অবশ্যই অধিকার আছে নতুন নামে, নতুন ফোনেটিক্সে কোনও একটি উপলক্ষকে বর্ণনা করার।”

তার কথায়, “কলকাতাও তো চিরকাল ক্রিসমাসকে বড়দিন নামেই ডেকে এসেছে। ভারত আসলে একটি বহু সংস্কৃতির, বহু ভাষার দেশ – কিন্তু এই ভাষার অংশটুকু বোধহয় এখানে ধর্মের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে।”

অশোকা ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক তিষা শ্রীবাস্তবও বিবিসিকে বলেন, “ভারতে আজকাল তো সবাই সব কিছুর প্রতিবাদ করে – অসহিষ্ণুতা এত বেড়ে গেছে যে সব ধরনের ট্রোলই চলে।”

“আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই প্রতিবাদটা করা হয় ঠিক-ভুল বা কনটেক্সট না বুঝেই, এখানেও ঠিক তাই হয়েছে।”

ফ্যাবইন্ডিয়া অবশ্য উৎসবের মরশুমে নিজেদের ব্যবসাকে বিপদে ফেলার ঝুঁকি নেয়নি, সোমবার রাতেই সব ধরনের প্ল্যাটফর্ম থেকে তারা তাদের জশন্ ই রিওয়াজ থিমের সব বিজ্ঞাপনই তুলে নিয়েছে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর