বেলুচিস্তানে গুম, খুন ও নির্যাতন চালাচ্ছে পাকিস্তান

পাকিস্তান অধিকৃত বেলুচিস্তানে বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তানের অবৈধ দখলের পর থেকে হাজার হাজার বালুচ অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছে। শত শত বালুচকে পাকিস্তানের ‘মেরে ফেল এবং গুম করে দাও’ নীতিমালার আওতায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার বালুচ এখনো নিখোঁজ রয়ে গেছেন।

সভ্য বিশ্ব এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নীরবতা ও অজ্ঞানতার কারণে এবং বেলুচিস্তানে মিডিয়া বা অন্যান্য উপায়ের অভাবের কারণে এই বিষয়টি আজ অবধি চাপা পড়ে আছে।

দখলদারিত্বের প্রথম দিন থেকেই বেলুচিস্তানের নিপীড়িত জনগণকে নিঃশব্দ করার জন্য বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গুম করে দেওয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। অগণিত বালুচকে অপহরণের পর হত্যা করা হলেও তাদের মধ্যে অনেককে এখনো সেনাবাহিনীর সিক্রেটস সেলে অমানবিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পাকিস্তানী রাষ্ট্রের হাতে বেলুচিস্তানে নিষ্ঠুরতার ভূলুন্ঠিত হচ্ছে মানবতা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছে বালুচরা। নিখোঁজ হওয়া পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে বা তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে অবিরত চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই প্রিয়জন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে মারা গেছেন। মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেও প্রিয়জনরা আর তাদের কাছে ফিরে আসেনি।

এই জাতীয় অপহরণ প্রক্রিয়া বেলুচিস্তানে চালানো হচ্ছে ১৯৪৮ সাল থেকে যখন শাসকগোষ্ঠী নিষ্ঠুরভাবে বেলুচিস্তান দখল করে নেয়। বেলুচ জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে ধর্মীয় উগ্রবাদী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং সন্ত্রাসীরা সম্মিলিত ভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদেরকে যেন লাইন্সে দেওয়া হয়েছে যখন খুশী যে কোন বালুচকে মারতে, খুন করতে ধর্ষণ করতে কোন বাধা নেই।

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত, মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের দুর্দশার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে না। বালুচ মা, বোন, বিধবা এবং তাদের সন্তানরা প্রিয়জনকে হারিয়ে মারাত্মক মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের অমানবিক অত্যাচারের কথা কখনই বাইরে প্রকাশিত হয় না, কারণ সেখানে মিডিয়ার প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ভয়েস অব বালুচ মিসিং পারসন (ভিবিএমপি) নামের একটি সংগঠন নিখোঁজ বালুচদের সন্ধান ও অপহরণকারীদের বিচারের দাবিতে ৪০৫০ দিনেরও বেশি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে আসছে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশ নেন। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও দেশটির সেনাবাহিনী মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটিকে কখনই বোঝে না এবং সম্মান করে না।

বলপূর্বক বেলুচিস্তানের নাগরিকদের নিখোঁজ হওয়া পাকিস্তানের মানবাধিকার রেকর্ডে দীর্ঘকালীন কলঙ্ক। ধারাবাহিকভাবে দেশটির সরকারগুলো এই অনুশীলনটি চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও সরকার ও সেনাবাহিনী সেটা আমলেই নেয়নি।

এদিকে, পাকিস্তান এখন প্রবাসী বালুচদেরও বিদেশে বলপূর্বক অপহরণ পদ্ধতি অনুশীলন করা শুরু করেছে। সম্প্রতি, বিশিষ্ট বালুচ সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী সাজিদ হুসেনকে ২০২০  সালের ২ মার্চ ইউরোপীয় দেশ সুইডেন থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। পরে তাঁর মৃতদেহ ২০২০ সালের ১ মে ইউসপালার একটি নদীতে পাওয়া যায়। তিনি প্রবাসে থেকে বেলুচিস্তানে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর নিখোঁজ ও হত্যার পেছনে পাকিস্তানি এজেন্সিগুলোর হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়।

সুইডেনে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জারিকৃত একটি প্রতিবেদন অনুসারে তারা সন্দেহ করেছেন যে, সম্ভবত সাজিদ হুসেনকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অপহরণ করেছিল।

এর আগে, আরেক বালুচ সামাজিক কর্মী রশিদ হুসেনকে ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। শারজাহ থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি। রশিদ বেশ কয়েক বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস ও কর্মরত ছিলেন। পরে পাকিস্তানি মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয় যে করাচিতে চীনা কনস্যুলেট হামলায় সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের একজন রশিদ। তাঁকে গ্রেপ্তারের খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও পরে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি পাকিস্তানের কোনো আদালতেও তাকে উপস্থাপন করা হয়নি। উল্টো সন্ত্রাসবিরোধী আদালত তাঁকে পলাতক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এখন তার জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার।

এই আধুনিক যুগেও পাকিস্তানি বাহিনী ও এজেন্সিগুলোর দ্বারা বালুচ জাতি সবচেয়ে খারাপভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতকে অবশ্যই কালবিলম্ব না করে বলপূর্বক বালুচ নাগরিকদের অপহরণ ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ