বিপন্ন আমেরিকার হাল ধরবেন বাইডেন

বিপন্ন কথাটি আমার একার নয়। আমেরিকার সিনেটর ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যসহ বড় বড় রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলছেন, একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু কলঙ্ক রচনা নয়, রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিকে যেভাবে তছনছ করে গেলেন, তার থেকে ভবিষ্যতে আর কোনো দিন আমেরিকা বের হতে পারবে কি না সন্দেহ। কেউ কেউ বলছেন, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে পরাশক্তির চূড়া থেকে আমেরিকার অধোগমন শুরু হলো। আমেরিকার বৈদেশিক নীতিনির্ধারক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের (সিআরএফ) বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস লিখেছেন, যদি পৃথিবীতে একক পরাশক্তি-উত্তর কোনো যুগের শুরু হয় বা আবির্ভাব হয়, তাহলে সবাই নিশ্চয়ই বলবেন, আমেরিকার নিঃশেষ হওয়ার যাত্রা শুরুর দিনটা ছিল ৬ জানুয়ারি, ২০২১।

একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হননি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা যা কিছু করেছে তার সম্মিলিত ব্যাকলাশের ধাক্কার পরিণতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে ঘটেছে ৬ জানুয়ারির কলঙ্কিত ঘটনা।

জো বাইডেন আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গণতন্ত্রের দুর্গখ্যাত ক্যাপিটল ভবনে সিনেটর ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা ৬ জানুয়ারিতে যৌথ অধিবেশনে বসেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশ ও উত্তেজনাকর বক্তব্যে রিপাবলিকান দলের হাজার হাজার সমর্থক সেখানে জমায়েত হয় এবং একপর্যায়ে তারা ক্যাপিটল ভবনে আক্রমণ চালিয়ে জানালা-দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে অধিবেশন কক্ষের সব কিছু তছনছসহ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে বিশ্বঘাতক বলে খুঁজতে থাকে। সভাপতির আসনে বসা মাইক পেন্স ও ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি অল্প সময়ের ব্যবধানে নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হন। তাঁরা দুজন অথবা যেকোনো একজন গুণ্ডাদের সামনে পড়লে আরো গুরুতর কিছু ঘটে যেতে পারত। তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জরুরি অবস্থা ঘোষণাসহ সংবিধান স্থগিত ও ৩ নভেম্বরের নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারতেন। তাতে ট্রাম্পের লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যেত; কিন্তু আমেরিকার পরাশক্তির মর্যাদার অপমৃত্যু ত্বরান্বিত হতো। ন্যান্সি পেলোসি সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলিকে জরুরি টেলিফোনে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের হুকুম দিলে তা যেন পালিত না হয়। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পাগলামির শেষ প্রান্তে তিনি ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের হুকুম দিতে পারেন। পুরো পৃথিবী ধ্বংসে মেতে উঠতে পারেন ট্রাম্প। সিনেটের সংখালঘু নেতা ও ডেমোক্রেটিক দলীয় চাক শুমার বলেছেন, ট্রাম্পকে অতিসত্বর হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দিতে হবে। অনেকে বলছেন, এক ঘণ্টার জন্যও তাঁকে হোয়াইট হাউসে রাখা ঠিক হবে না। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন দ্বিতীয়বার অভিশংসন প্রস্তাব উঠেছে প্রতিনিধি পরিষদে, যদিও সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সেটি গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ৬ জানুয়ারির তাণ্ডব হঠাৎ করে বা পূর্বাভাস ছাড়াই ঘটেছে তা কিন্তু নয়। প্রায় এক সপ্তাহ আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই সমাবেশের ঘোষণা এবং চরম উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। অথচ নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সেদিন যথেষ্ট প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কেন নিল না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে আমেরিকার গর্ব ও রক্ষাকবচ, ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান সর্বেসর্বা, এই জায়গাটিতেও তাহলে কি পচন ধরেছে। ঘটনার তিন দিন আগে লিওন প্যানেটা ও রবার্ট গেটসসহ ১০ জন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সতর্ক করেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাগলামির সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী যেন জড়িত না হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, ট্রাম্পের পক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ছিল। এশিয়া-আফ্রিকার অনেকে ক্ষুব্ধ মনে বলেছেন, সেটা হলেই বোধ হয় ষোলোকলা পূর্ণ হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের গোপন অপারেশনে সেসব দেশের সামরিক বাহিনীর দ্বারা গণতন্ত্রের কবর রচনার সেই যে ইতিহাস তারই পুনরাবৃত্তি তাহলে খোদ আমেরিকার মানুষ দেখতে পেত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং এক নম্বর দেশ আমেরিকা। আগামী দিনে কী হবে তা নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও এই শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় পৌঁছাবার শক্ত ভিত্তি রচনা করেন আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা। উদার গণতান্ত্রিক, ক্ষমতার চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রক্ষার অনন্য কঠিন ব্যবস্থাসহ বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের মৌলিক আদর্শ মূল সংবিধানে এমনভাবে প্রোথিত করা হয় যে প্রায় আড়াই শ বছরেও সেটি সংবিধানে সেই রকমই অটুট আছে। তবে স্বাধীনতার পর রাতারাতি সব কিছু হয়ে যায়নি। দীর্ঘ কঠিন পথ বেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় এসেছে আমেরিকা। চরম বৈষম্যমূলক দাস প্রথা বাতিলের জন্য স্বাধীনতার ৮০ বছরের মাথায় আরেকটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে আসতে হয়েছে, যাতে প্রায় সাত লাখ মানুষ নিহত হয়। ফাউন্ডিং ফাদার না হয়ে সেই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে দাসপ্রথার পক্ষ নেওয়া এক চরম সন্ত্রাসীর গুলিতে ১৯৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রাণ দিতে হয়। কৃষ্ণাঙ্গরা ভোটাধিকার পেয়েছে এই সেদিন, ১৯৬৫ সালে। সংবিধানের মৌলিকত্ব অক্ষুণ্ন ছিল বলেই পর্যায়ক্রমে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে গত চার বছর এবং ৬ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প যা ঘটালেন, তাতে অসামান্য সেই সংবিধানকে শুধু কাগজের বান্ডেল মনে হয়েছে। অজ্ঞতা আর মেধাহীনতার অন্ধত্বে থাকা ব্যক্তিকে জনগণ দেশের নেতা হিসেবে বেছে নিলে এবং সেই নেতাকে যদি ক্ষমতার লিপ্সা ও পাগলামিতে পেয়ে বসে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে সেটির প্রতীকী উদাহরণ হয়ে থাকবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

২০ জানুয়ারির পর দৃশ্যপট থেকে ট্রাম্প হয়তো চলে যাবেন, তিনি যে আমেরিকা রেখে গেলেন তা নিয়ে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকান নেতৃত্ব কতখানি সামনে এগোতে পারবে, সেটা নিয়েই এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। সশস্ত্র বাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে চরম বিভাজনের যে ভয়াবহ বিষবাষ্প ট্রাম্প ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন তার থেকে আমেরিকা কখন মুক্ত হবে অথবা আদৌ হতে পারবে কি না সেটাই ভবিষ্যতে দেখার বিষয়। মানুষ খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে না। গত চার বছরের কর্মকাণ্ডে হ্রাস পাওয়ার বদলে এবার এসে ভোটপ্রাপ্তি ট্রাম্পের পক্ষে শতকরা ৩ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাগ্য ভালো, ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনকে ভোট না দেওয়ার সংকল্প নিয়ে বিরাটসংখ্যক যে ডেমোক্রেটিক দলীয় ভোটাররা ঘরে বসেছিলেন, তাঁরা ২০২০ সালে এসে ব্যাপকভাবে জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু চার বছরে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দেশের নেতৃত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য নেতিবাচক হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প উদাহরণ হয়ে থাকবেন। গত চার বছরে তিনি আমেরিকার অভ্যন্তরে এবং বিশ্ব অঙ্গনে যে জঞ্জাল তৈরি করেছেন তার ভার ৭৮ বছর বয়সী নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কতখানি সফলতার সঙ্গে বহন করতে পারবেন, সেটাও এখন ভাবনার বিষয়।

আমেরিকান ফার্স্ট নামের সস্তা স্লোগান দ্বারা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ, ইভেনজেলিক্যাল খ্রিস্টীয় কট্টরবাদ, ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ (গান কন্ট্রোল), বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে ট্রাম্প যেভাবে উত্তেজিত ও সংঘবদ্ধ করেছেন, তার পরিণতিতে আগামী দিনে আমেরিকার অভ্যন্তরে বর্ণবাদী দাঙ্গা, যত্রতত্র শুটিংয়ের মাধ্যমে নিরীহ মানুষের জীবনাবসান এবং অভিবাসী, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হেইট ক্যাম্পেইন ও বিদ্বেষ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কঠিন কাজ হবে। আমেরিকার কলামিস্টরা বলছেন, বোগাস আমেরিকা ফার্স্ট নীতির ফলে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক্যাল পার্টনার ইউরোপসহ বিশ্ব অঙ্গন থেকে সরে যাওয়ায় ফাঁকা মাঠের সব কিছুই দখলে নিয়েছে চীন ও রাশিয়া। গুরুত্বপূর্ণ ২০১৫ সালের জলবায়ু চুক্তিসহ আরো অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সমঝোতা বাতিল এবং সর্বশেষ কভিড-১৯-এর চরম প্রাদুর্ভাবের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহারের মাধ্যমে সুপারপাওয়ারের মর্যাদা ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতার যত বড় ক্ষতি ট্রাম্প করেছেন, তা আবার ফিরিয়ে আনতে জো বাইডেন প্রশাসনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। ১৭ জানুয়ারিতে কট্টর ট্রাম্পপন্থীরা সশস্ত্র বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। ট্রাম্প ২০ জানুয়ারিতে ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে থাকবেন না, বরং তাঁর সমর্থকরা ওই দিন সব অঙ্গরাজ্যে আদালতের সামনে বিক্ষোভ করবে। ওয়াশিংটন ডিসিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। আমেরিকার ২৩৮ বছরের ইতিহাসে সব কিছুই নজিরবিহীন ঘটনা। কেউ কেউ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। সব মিলিয়ে বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকে আজ সত্যিই বিপন্ন মনে হচ্ছে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ