নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুর্গাপুরের আমগাছী গ্রামের আনারুল ইসলাম। পেশায় ভ্যানচালক। গত ৫ দিন ধরে ভ্যান চালাতে পারেননি রাস্তায়। এরই মধ্যে বাসায় দুই-তিন কেজি যে চাল ছিলো সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। আনারুলের স্ত্রী প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল ধার করে গত দুদিন ধরে সংসার ভাত রান্না করছেন। কিন্তু ভাত খেতে তো তরকারির প্রয়োজন হবে। সেটি পাবেন কোথায়। তাই বাধ্য হয়ে দুই কেজি আলু কিনে এনে অধিকাংশ সময় ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে দিন পার করছেন আনারুলের পরিবার।
আনারুল জানান, তাঁদের গ্রামের সরকারের উদ্যোগে ১০ কেজি করে চাল পেয়েছে কিছু কিছু লোকজন। তবে অধিকাংশ গরিবই এখনো সেই চাল পাননি। আবার যারা চাল পেয়েছেন তারা এরই মধ্যে তরকারি সঙ্কটে পড়েছেন। এভাবে আর কতদিন পার করতে হবে তাদের এ নিয়ে যেন কঠিন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এই মানুষগুলো।
কিন্তু এখনো এই গ্রামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। এমনকি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপিও ব্যক্তিগত কোনো সহায়তার হাত বাড়াননি। ফলে কেবল সরকারি সহায়তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে। এ নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকেও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক হারে। অনেকেই এলাকার নাম ধরে ধরে ফেসবুকে সেই এলাকার এমপিদের নিরবতার বিষয়টি তুলে ধরছেন।
শুধু এই গ্রামেই নয়, রাজশাহীর প্রতিটি গ্রামেই এখন এমন অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে খেটে খাওয়া মানুষগুলো পড়েছে চরম বিপাকে। সরকারি নির্দেশে ঘরের বাইরে যেতে না পেরে, রাস্তায় নামতে না পেরে হাজা হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন একেকটি গ্রামে। যাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কর্তাদের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাজ। তারা না পারছেন কারো নিকট হাত পাততে আবার না পাচ্ছেন সরকারি সহযোগিতা। এই অবস্থায় তারাও ভালো নেই পরিবার-পরিজন নিয়ে। কারণ এসব পরিবারগুলোও অনেকটা প্রতিদিনের আয়ের ওপরই নির্ভরশীল। হয়তো ছোট-খাটো ব্যবসা, নয়তো ছোট খাটো চাকরি বা নিজের জমিতে খেটেই দু’মুঠো ভাত জোটান পেটে। এই পরিবারগুলোও এখন চরম বিপদগ্রস্থের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন গ্রামবাসী।
সরেজমিন ঘুরে দেখো গেছে, ২৬ মার্চ থেকে মূলত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন রাজশাহীর খেটে খাওয়া মানুষগুলো। দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোরিকশা চালক, সিএনজি চালক, বাস চালক থেকে শুরু করে ছোট ছোট পান-সিগারেটের দোকান করে যারা এতোদিন সংসার চালিয়ে আসছিলেন তারাও একই কাতারে। এদের অধিকাংশরই বাড়িতে কোনো খাবার মজুদ নাই। দুই-চার কেজি চাল-ডাল থাকলেও সেগুলোও হয়তো কারো কারো বাড়িতে এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আবার কারো শেষের পথে।
পুঠিয়ার ভড়ুয়াপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, শুনছি সরকার নাকি সহযোগিতা করবে আমাদের। কবে করবে? ঘরের বাইরে যেতে না পারি, কাজ করতে না পারি খাওয়ার ওভাবে মরি যাওয়ার পরে করবে? আমরা এখুনই সহযোগিতা চাই। আমারে বাড়িতে খাওয়ার জমা নাই নাই যে দিনের পর দিন বসে থ্যাকি খ্যাতে পাবো।’
একই গ্রামের হযরত আলী বলেন, ভোটের সময় নেতারাদের ভিড় দেখা যায়। এখুন নেতারা কুণ্ঠে আছে? আমাদের এই বিপদে তারা অন্তত দুইমুঠ চাল নিয়ে এসে দেখা করুক। সরকারি চাল তো সব লোকে পাবে না। তাহলে অন্যরা কি খাবে? আর চাল পালেও ভাত খাবো কি দিয়ে?
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী শহরেও প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। যদিও প্রায় ২০ হাজার কর্মহীন মানুষকে সিটি করপোরেশনের মেয় এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের উদ্যোগে ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চালসহ খাদ্য সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা, বিভিন্ন ব্যক্তিও ত্রাণ নিয়ে নেমেছেন মাঠে। কিছু লোকজন সহায়তা পাচ্ছেন। সিটি করপোরেশন ২০ হাজার লোককে সহযোগিতা করেছে।
তবে কয়েক লাখ কর্মহীন মানুষ রয়েছে এই শহরে। ফলে এই অনুদান না পাওয়া অধিকাংশ পরিবারই পড়েছেন বিপাকে।
নগরীর বিলসিমলা এলাকার শাহিদা খাতুন নামের এক নারী জানান, পরের বাড়িতে কাজ করেনন তিনি। করোনা আতঙ্কে ও গুজবে অনেকেই কাজ থেকে বাদ দিচ্ছেন বুয়াদের। তার রিকশাচালক স্বামীও বেকার হয়ে গেছেন। তাকেও হয়তো যেকোনো সময় বাদ দেয়া হবে। এই অবস্থায় সংসার চালাতে ব্যাপক হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু এখনো কোনো সহযোগিতা পাননি শাহেদা।
এদিকে জেলার ৬ এমপির ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোথাও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো খাদ্য সরবরাহ বিতরণের খবর পাওয়া যায়নি। তবে গতকাল তানোরে এমপি ফারুক চৌধুরী জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটিয়েছেন কিছু সময়। আর পুঠিয়া-দুর্গাপুরে এমপি মনসুর রহমান লিফলেট বিতরণ করেছেন সাধারণ মানুষের মাঝে।
যদিও গতকাল বিকেলে পুঠিয়া-দুর্গাপুরে ব্যবসায়ী ও জেলা যুবলীগের নেতা ওবায়দুর রহমানের উদ্যোগে প্রায় তিনশ মানুষকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে ছোট ছোট আকারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু ত্রাণ বিতরণ হয়েছেন সাধারণ মানুষদের পক্ষে। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে আঙ্গুলফুলে কলাগাছবনে যাওয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র নেতা ও পাতিদের ত্রাণ নিয়ে তেমন মাঠে নামতে দেখা যায়নি।
স/আর