বিনম্র শ্রদ্ধা : বিদায় সুরের যাদুকর এন্ড্রু কিশোর

মোঃ কায়ছার আলী:


“ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে”, অথবা “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস”। মরণের ডাককে বারংবার স্মরণ করে অনুভুতির অবিনশ্বর মূর্ছনাকে বা মর্ম বিদায়ী আবেদনকে কোটি কোটি ভক্ত অনুরাগীদের অসংখ্য গানের সুরের স্রোতে মুগ্ধ করে এবার সত্যিই না ফেরার দেশে গত ৬ জুলাই চিরতরে চলে গেলেন সুরের যাদুকর এন্ড্রু কিশোর (১৯৫৫-২০২০)। দয়ালের ডাক এসে গেলে সবাইকে ঠুস হতে হয়। তাই তো যেই রাজশাহীতে জন্ম, সেখানেই শেষ বিদায়। জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নিকাশে কি আছে জানি না তবে এটুকু জানি তিনি ৮ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

বাংলা সিনেমার সোনালী যুগে বা জোঁয়ারের সময় তাঁর শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বর ছিল পরানের গহীনে শতশত আকুতি ভরা সুরের তালে তালে ছন্দে ছন্দে মোহিত করা একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। হাসি আনন্দ, প্রেম বিরহ সর্বক্ষেত্রে গান গেয়ে তিনি আপামর জনগণের মনকে দোলা দিয়েছেন। গান শুধুমাত্র বিনোদনই নয়, কিছুটা জ্ঞান বিনিময়ের পথ। গানের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত বা ঘুণে ধরা সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম হাতিয়ারও বলা যায়।

অনেকে জানে না গানটির সুরকার কে? গীতিকার কে? কিন্তু তারা শিল্পীকে বা অভিনয় শিল্পীকে চিনেন এবং ঐ সিনেমার নামটি জানেন। আপনার যে অসুখটি হয়েছিল সে অসুখে যমদুত ছায়ার মত সংগী হিসেবে রয়ে যায়। সকল ক্ষেত্রে বলা ঠিক নয় “ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়”। মানুষ ইচ্ছা করলে হাজার বছর বাঁচবে না, পুনরায় শিশু হবে না, রাজা হতে পারবে কি না জানি না, যৌবনের সৌন্দর্য চিরকাল ধরে রাখতে পারবে না আর হারনো সময় কখনও ফিরে পাবে না। জীবনটাই হল মৃত্যুর জন্য তৈরি।

অপ্রিয়, অবিনশ্বর, অমোঘ এই চিরন্তন রীতির কাছে সবাই পরাজিত হতে বাধ্য। কীর্তিময় জীবন হোক বা না হোক সবাই এর স্বাদ একদিন পাবে। তুমুল জনপ্রিয় গায়কির অনন্য শৈলিতে নিজেকে উন্নীত করেও তিনি সাদামাটা জীবন যাপনের অধিকারী ছিলেন। ভদ্র, বিনয়ী ও মার্জিত মানুষটিকে নিয়ে কখনো কোন বিতর্ক হয় নি। অনেক মানুষ হঠাৎ চলে যায়, বলে যায় না বা যেতে পারে না। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার আর সময় নেই। তাই তো নিজেই দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরতে চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন “দেশে গিয়ে মরতে চাই”। অত্যন্ত নির্দয়, নিষ্ঠুর যমদুত এ মায়াভরা জগৎ সংসারে হাজির হয় নিতে, দিতে নয়।

দেখতে দেখতে অনেক কিংবদন্তী চলে গেলেন, শুন্য হল অনেক জায়গা, অনেক পদ পদবী। হয়তো ধীরে ধীরে সবই স্বাভাবিক হবে। সকল সৃষ্টি জগৎ একদিন ধ্বংস হবে, শুধুমাত্র রয়ে যাবেন চিরঞ্জীব বিধাতা। তিনিই মহাবিচার করবেন। দেহগত দুর অচিনপুরে রইলেও তিনি রয়ে যাবেন শুদ্ধ সংগীত চর্চায় এক মায়াভরা কন্ঠস্বরে, সুরে। গুণীদের কাতারে রয়ে যাবে তাঁর অমর নাম। কোনদিন মুছে যাবে প্রায় ১৫০০০ গান গাওয়া প্লে-ব্যাক সম্রাটের উপাধী। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সূর্যের মতো শাশ্বত, স্বরে দ্যুতি ছিল বেশি। যার শ্রোতাদের যাদুর মতো মুগ্ধ করত।

তিনি ছিলেন বাংলা গানের ঐশ্বর্য। “ভেজা চোখ” সিনেমায় মরন ব্যাধিতে আক্রান্ত ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর যে অমর গানটি গেয়েছিলেন “জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প”। সেই অল্প সময় বাকি থাকতেই তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর। সেখানে ১৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর ব্ল্যাড ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার খবরটি ছিল সকলের জন্য বিশাল আঘাত। ১০ মাস দীর্ঘ মেয়াদী ও ব্যয় বহুল চিকিৎসায় তাঁকে সহায়তা করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রবাস থেকে তাঁর দুই সন্তান দেশে আসছে। তাঁর স্ত্রী ইতি কিশোর যথার্থই বলেছেন “তিনি শুধু তাঁর বা তাঁদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটি অংশ বা সম্পদ”। “নয়নের আলো” সিনেমায় অভিনীত জাফর ইকবাল আজ বেঁচে নেই, কিন্তু ঐ সিনেমার সেই অমর গানটি যেটা তাঁর অসুস্থ মাকে উদ্দেশ্য করে গেয়েছিলেন সেই গানটি রয়েই গেল” আমার সারা দেহ খেওগো মাটিও শুধু চোখ দুটো মাটি খেও না, আমি মরে গেলেও তাঁরি দেখার স্বাদ মিটবে না গো মিটবে না। তাঁরে এক জনমে ভালবেসে ভরবে না মন, ভরবে না,,,,,,,,”।

সারাজীবন জুড়ে মাটির সন্তান মাটির সন্ধান করে গেছেন। অবশেষে মাটির কাছেই ঠাঁই নিলেন। বিধাতার কাছে মিনতি একলা মাটির ঘরে থাকতে যেন তিনি ভয় না পান এবং দুচোখ দিয়ে যেন তিনি দেখতে পান দেশে বিদেশে কোটি কোটি ভক্ত অনুরাগীকে। মাটির ঘর তথা পরপারে ভাল থাকুক এ মহান শিল্পী। এটা শুধু আমার নয়, আমাদের প্রার্থনা।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, ০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪[email protected]