বিদেশি অপরাধী বাড়ছে দেশে, দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেই

আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশে অপরাধ করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আস্তানা গাড়ছে দুর্ধর্ষ কিছু অপরাধী। ঢাকায় বসেই আন্তর্জাতিক প্রতারকচক্র চালাচ্ছে তারা। এই অপরাধীদের সিন্ডিকেট তাদের দেশের অন্যদের এখানে লেখাপড়াসহ খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ করে দিতে স্পন্সর হচ্ছে, ভ্রমণ ভিসা পেতে সহায়তা করছে। সম্প্রতি কয়েকটি অপরাধী সিন্ডিকেটের সদস্য গ্রেপ্তারের পর তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিভিন্ন সংস্থা আলাদাভাবে নজরদারি করায় কৌশলে নিজেদের অবস্থান গোপন করছে বিদেশিরা। অনেকে পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে পরিচয় আড়াল করছে। চাইলেও সহজে তাদের দেশও শনাক্ত করা যায় না। প্রচলিত আইনে তাদের ফেরত পাঠাতে অনেক সময় প্রয়োজন। কেননা অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। করোনার আগে থেকে অপরাধীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো ‘পুশব্যাক’ পদ্ধতিও বন্ধ আছে। এসব ‘দুর্বলতার’ সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি অপরাধীরা। এ অবস্থায় এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের।

গত তিন মাসে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও র‌্যাব অন্তত ৬০ জন কৃষ্ণাঙ্গ বিদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে। গত তিন বছরে এই গ্রেপ্তারের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহারের নামে প্রতারণা; হেরোইন, কোকেনসহ অপ্রচলিত মাদকের কারবার; ব্যাংকের এটিএম বুথের জালিয়াতি; বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার; অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা; সোনা চোরাচালান; অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাচারে এসব অপরাধীর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিটি দলে বাংলাদেশি নারী সদস্য রয়েছেন, যাঁদের উপহার গ্রহণের নামে টাকা নিতে কাস্টমস কর্মকর্তা সাজানো হয়। গত ৬ আগস্ট র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন জেকভ নামে এক নাইজেরিয়ান। রাজধানীর প্রগতি সরণিতে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ‘আফ্রো-এশিয়ান’ নামে তাঁর একটি রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে বসে নাইজেরিয়ান অপরাধী ও অবৈধ বসবাসকারীরা পরিকল্পনা করে বলে তথ্য পেয়েছেন সিআইডির তদন্তকারীরা।

গত ৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় ৭০০ বিদেশি নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। তার পরও তাঁরা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করছি তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। এমবাসিগুলো যদি কোনো উৎসাহ না দেখায়, তাহলে আমরা আমাদের দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদেশি অপরাধীদের জন্য পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেব।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দেশে প্রায় দুই লাখ বিদেশি অবস্থান করছে। বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে আছে পাঁচ শতাধিক। বন্দি অন্তত ৭০ জনের শাস্তির মেয়াদ শেষ হলেও তাদের দেশ উদ্যোগ না নেওয়ায় তাদের ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না।

বাইরে থাকা অবৈধ বিদেশিরা কোথায় আছে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কি না, আগে থেকে সে তথ্য থাকে না প্রশাসনের কাছে। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে। তবে পাসপোর্ট ফেলে দেওয়া পলাতক হিসেবে এবং অপরাধী হিসেবে তাদের আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় না। অভিযানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ সংকটের কথা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন  বলেন, ‘আফ্রিকানসহ অনেক বিদেশি ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। তখন বের করাই যায় না এঁরা কোন দেশের। এঁদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। তাই আমরা দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দিয়েছি।’

সিআইডি ও ডিবি সূত্র জানায়, পাসপোর্ট ফেলে দেওয়ার পর অবৈধদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার এবং নিজ দেশে দ্রুত ফেরত পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। পুলিশ ইন্টারপোল এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে এটি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যায়। সব সংস্থার সমন্বিতভাবে নজরদারি না করার সুযোগ নেয় চতুর বিদেশি অপরাধীরা।

আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা করে ফেরত পাঠাতে হয়। দাগি অপরাধীদের ক্ষেত্রে পুশব্যাক করার রীতিও চালু আছে। তবে চলতি বছর করোনার কারণে এটি বন্ধ আছে। বাংলাদেশে ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬ অনুযায়ী, অবৈধভাবে বসবাসের জন্য গ্রেপ্তারের পর পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে।

সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শেখ রেজাউল হায়দার  বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি কয়েকজন অপরাধীর তথ্য পেয়েছি, যাঁরা নাইজেরিয়া, কেনিয়াসহ নিজ দেশে অপরাধ করে পালিয়ে এসেছেন। এঁরা আন্তর্জাতিক অপরাধী গ্যাং/গ্রুপে জড়িত। এঁরা কিভাবে দেশে ঢুকে পড়ছেন, সেটাও দেখা দরকার।’

তিনি আরো বলেন, ‘র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার জেকভের আফ্রো-এশিয়ান রেস্তোরাঁয় অপরাধীদের আড্ডা হয়। রেস্তোরাঁটির ব্যাপারে আমরা এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। এই জেকভ অনেক নাইজেরিয়ান শিক্ষার্থীর স্পন্সর হয়েছেন। তাঁরা এসে অপরাধে জড়িয়েছেন। ফলে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কারা জড়িত, সেটাও নজরদারির মধ্যে আনা দরকার।’ এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ