সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :
পিলিখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক নানা আলোচনার প্রেক্ষিতে কথা বলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ যিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান ছিলেন। নিজ ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় আধা ঘণ্টার ভিডিও পোস্ট করেন তিনি।
শুরুতে তিনি উলেখ করেছেন “বিদ্রোহের ১৫ বছর ধরে আমরা শুধু সরকারের কথাই শুনে গেছি, প্রকৃত ঘটনা অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই এবং জনগণও জানতে পারেনি।”
সরকার থেকে তদন্ত আদালত করতে পারার বা সে সংক্রান্ত সাহায্য সহযোগীতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি।
“যখন আমি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তদন্তের আদেশ দিয়েছি তখন আমাকে বলা হলো যে সরকার যখন তদন্ত আদালত করছে তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই আদালতের প্রয়োজনটা কী?” উলেখ করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
৫৭ জন সেনা অফিসারের হত্যার প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা উলেখ করে তিনি জানান “এরপর তেমন কিছু সরকার থেকে উচ্চবাচ্য আসেনি, তবে এ তদন্ত আদালত করতে যেসব জিনিস প্রয়োজন তা সেভাবে সরকার থেকে আমরা সাহায্য পাইনি।”
বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সেনাবাহিনীর সেসময়ের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি সেসময় লেফট্যানেন্ট জেনারেল ছিলেন। জড়িতরা জেলে ছিল এবং তাদের সামনে আনা বা প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি বলে তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়নি বলে উলেখ করেন মিঃ আহমেদ।
“সেনাবাহিনীর তদন্ত চলাকালীন জেনারেল জাহাঙ্গীর কয়েকবার আমার কাছে এসে বেশ কয়েকবার তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন।” এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হওয়ায় পুনরায় তদন্ত করে জড়িতদের করার বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
কী ঘটেছিল সেদিন এবং কার কেমন ভ‚মিকা সেগুলো তুলে ধরেছেন তিনি।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে একটি গুরুত্বপ‚র্ণ মিটিং-এ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। সেসময় সিজিএস লেফটেনেন্ট জেনারেল সিনহা তাকে এসে জানান কিছু ৮১ মিলিমিটার মর্টার আছে যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না যেগুলো গুদামজাত ও রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন। তবে বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে এবং সেগুলো তারা নিয়ে গেলে সুবিধা হবে।
তিনি জানান বিডিআর এর ডিজি জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তিনি এগুলো নিতে সানন্দে রাজি হন। জেনারেল শাকিলের সাথে কথাবার্তায় যেমন উদ্বুদ্ধ ছিলেন তাতে করে মিঃ আহমেদ ধারণা করেন সেদিন সকালেও ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কোনও ধারণা ছিল না তার।
বিভিন্ন স‚ত্র থেকে খবর পেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও ফোন ব্যস্ত ছিল।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় তাৎক্ষণিকভাবে কারও নির্দেশ ছাড়া পদক্ষেপ হিসেবে ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’নামে অপারেশনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন বলে জানান।
৯টা ৪৭ মিনিটে ডিজি বিডিআরকে ফোনে পেলে তখন পরিস্থিতির ভয়াবহতার বিবরণ পান তিনি। পরিস্থিতির বিবরণে তার মনে হয়েছে “এগুলো সবই মনে হয় প্ল্যান করা এবং প্ল্যান অনুযায়ী, সব চলছে।”
“৯টা ৫৪ মিনিটে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মোবাইল টেলিফোনে পেলাম। এর মধ্যেই তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেছিলেন।”
প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্রিগেড সেখানে পৌঁছায়।
মিঃ আহমেদ উলেখ করেন “লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই বেশিরভাগ অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে, আর আমাদের ব্রিগেডটি পৌঁছায় ১১ টার পরে।”
তিনি আরও জানান জানান, “ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে তিনি পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এসময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অনুমতি চান পিলখানায় প্রবেশ করার জন্য যেটা তিনি পাননি।”
সেই দলটি যদি অনুমতি পেত তাহলে পরবর্তীতে সেনা ব্রিগেডের সমন্বয়ে বিষয়টা সহজে সামাল দেয়া যেতো বলে উলেখ করেন তিনি। বাইরে গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে গোয়েন্দা থেকে কোনও তথ্য তারা পাচ্ছিলেন না, শুধু মিডিয়ার লকজন লাইভ কভার করছিল। বিডিআররা সেসময়য় ভুল তথ্য দিচ্ছিল বলে জানান্ন তিনি।
১১ টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোন আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাই সরকার আদেশ করলো ৪৬ ব্রিগেড ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যারা এসেছে তারা যেন দৃষ্টির বাইরে চলে যায় (আউট অফ সাইট)।”
তিনি জানান, বেলা ১২টায় জরুরিভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে ডাকা হয় এবং সেনাবাহিনী আড়াল হলে বেলা ১টার দিকে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।”
যমুনায় দুপুরে পৌঁছানর পর সেখানে বহু মানুষের সমাগম দেখেছেন তিনি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তার আসার খবর জানানো হলেও “আমি ভেবেছিলাম তিনি আমাকে ভেতরে ডেকে নেবেন, কিন্তু তা করা হলো না।”
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠক, এরপরে আরও একটি বৈঠক সেরে এরপর তিন বাহিনীর প্রধানকে ডাকেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টার কথা জানান।
বিদ্রোহীদের সাথে দেনদরবার, সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে টানাপড়েন, সেসব মিলে সেদিনের ঘণ্টা ঘণ্টা ধরে কী কী ঘটেছে এসবের বিবরণ দেন তিনি যেভাবে আলোচনা চলছিল বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে।
রাত ১২ টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আইন প্রতিমন্ত্রী তাপস এবং আইজিপি পিলখানায় যান, এরপর “বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্র সমর্পণ করে এবং ৮টি পরিবারকে মুক্তি দেয় যার মধ্যে ৩টি পরিবার ছিল সেনাবাহিনীর অফিসারদের পরিবার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জানতেন, অফিসার্স এবং পরিবারদের কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাদের মুক্তির ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেননি এবং তাদের সম্পর্কে খোঁজখবরও নেননি। তিনি ৮ টি পরিবারকে নিয়ে পিলখানা থেকে বের হয়ে আসেন।”
২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিদ্রোহীরা আবারও গোলাগুলি শুরু করে এবং বেঁচে যাওয়া অফিসারদেরকে, যারা লুকিয়ে ছিল তাদের খুঁজতে থাকে। তারা কোয়ার্টার গার্ডে অফিসার এবং পরিবারদের হত্যার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সকাল ১০টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবার আমাকে যমুনায় যেতে বলেন।
এদফায় সামরিক অভিযানের অনুমতি পান তিনি। ট্যাংকসহ সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি দেখে বিডিআর সদস্যরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত হয় বলে জানান তিনি।
ভিডিওর শুরুতে এবং শেষে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন মইন ইউ আহমেদ। এ সময় বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা