বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্র

কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনায় সোমবার (১ জুন) ৭ম দিনের মতো উত্তাল বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ৪০টি শহরে কঠোর কারফিউ জারি করার পরও তা উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসেন বিক্ষোভকারীরা। এদিনও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। হোয়াইট হাউসসহ বিভিন্ন এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরতদের ওপর পুলিশকে টিয়ার গ্যাস ছুড়তে দেখা গেছে।

মিনেসোটা, ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে বেশ ক’জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিক্ষোভ চলার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পাঁচ পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আর শিকাগোর সিসেরো এলাকায় দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছে। শহরের মুখপাত্র রে হানানিয়া জানিয়েছেন, সিসেরোর বাইরে থেকে আসা দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তবে নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করেননি তিনি।

পুলিশি নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। বিক্ষোভ এসে পড়েছে হোয়াইট হাউসের সামনেও। রোববার রাতে হোয়াইট হাউসের পাশের রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। সহিংসতার মুখে অন্তত ৪০টি শহরে কারফিউ জারি হলেও তা ভেঙে রাস্তায় নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। এই নিয়ে রোববার যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ-সহিংসতা ষষ্ঠ দিন পার করেছে।

সোমবার ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে কারফিউ শুরুর আগেই বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক ও গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ করছিল বলে উল্লেখ করেন সিমন। তবে টুইটারে দেওয়া বিবৃতিতে ওকল্যান্ডের পুলিশ বিভাগ দাবি করে বিক্ষোভকারীরা কারফিউ ভঙ্গ করেছে। ৪০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করার কথা জানিয়েছে তারা।

মিনেসোটার সেন্ট পলের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা সোমবার রাতে অন্তত ৬৬ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে। এদিন বিক্ষোভকারীরা মিছিল করতে করতে করতে গভর্নর ম্যানশন থেকে ক্যাপিটলের দিকে এগিয়ে যায়। তবে রাত ১০টায় কারফিউ কার্যকর হওয়ার পরও কিছু বিক্ষোভকারী অবস্থানস্থল ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তাদেরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষোভরতদের সরিয়ে দিতে সামরিক হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে দেখা গেছে। অন্তত একটি হেলিকপ্টার বিক্ষোভকারীদের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো ধূলো উড়াচ্ছিল।

হোয়াইট হাউস এলাকায়ও চলছে বিক্ষোভ। সোমবার হোয়াইট হাউসের কাছে বিক্ষোভরতদেরকে সরিয়ে দিতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এর কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে একটি গির্জায় গিয়েছেন। সেখানে বাইবেলের সঙ্গে একটি ছবিও তোলেন তিনি।

এদিকে নিউইয়র্কের বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট হচ্ছে উল্লেখ করে সোমবার বিক্ষোভকারীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান গভর্নর বিল দে ব্লাসিও। তিনি জানান, অনেকে বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে লুটপাট করছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, অন্যকে আঘাত করছে। তবে তার বিবৃতির পর সোমবার রাতেও অনেক দোকানের জানালার কাঁচ ভেঙে লুটপাট হয়েছে।

এদিকে রোববার রাতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর ফেডারেল পুলিশের চালানো দমন-পীড়নকে ‘লজ্জাজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মুরিয়েল বৌসের। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘আমি সন্ধ্যা ৭টা থেকে কারফিউ জারি করেছিলাম। কিন্তু তার ২৫ মিনিট আগেই কোনো রকমের উসকানি ছাড়াই হোয়াইট হাউসের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরতদের ওপর পুলিশ অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ওয়াশিংটন পুলিশ বিভাগের কাজকে কঠিন করে তুলবে। এটা লজ্জাজনক।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরে ফিরে নিরাপদে থাকার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন মুরিয়েল। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে পুলিশ-বিক্ষোভকারী মুখোমুখি অবস্থান সত্ত্বেও কিছু কিছু এলাকায় আবার পরস্পরের সংহতিও দেখা গেছে। আটলান্টা, ডেনভার ও নিউ ইয়র্কে পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের জড়িয়ে ধরতে দেখা গেছে। কেউ কেউ আবার হাঁটু গেড়ে বসে ফ্লয়েডকে স্মরণ করেছেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছেন।

রোববার হোয়াইট হাউসের সামনে হাজার খানেকের বেশি বিক্ষোভকারী রাস্তার সাইন পোস্ট, পস্নাস্টিকের ডিভাইডার, গাছের শুকনো ডাল জড়ো করে তাতে আগুন ধরায়। এক বিক্ষোভকারী আবার তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পতাকা ফেলে দেয়। হোয়াইট হাউসের সামনের গেটেও পাথর ও বোতল ছোঁড়ে বিক্ষোভকারীরা। এরপর হোয়াইট হাউসের বাইরের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়।

ট্রাম্পের পরামর্শদাতারা তাকে বলেছেন, তিনি যেন অবিলম্বে টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তবে ট্রাম্প এখন পর্যন্ত সেই পরামর্শ মানেননি। তিনি টুইট করে বলেছেন, ‘ডেমোক্রেট মেয়র ও গভর্নররা যেন কড়াভাবে বিক্ষোভের মোকাবিলা করেন’। তবে রোববার তিনি অন্তরালেই থেকেছেন। হোয়াইট হাউসেও কর্মীদের বলে দেওয়া হয়েছে, বিক্ষোভ চলতে থাকলে তারা যেন না আসেন। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় পুলিশের অত্যাচারে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে। যত দিন যাচ্ছে, ততই বিক্ষোভ বাড়ছে।

রোববার হোয়াইট হাউসের পাশের একটি পার্কেও বিক্ষোভকারীরা জড়ো হলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, পিপার স্প্রে ছোড়ে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেডও ফাটানো হয়। ওয়াশিংটন মনুমেন্টের কাছে বিক্ষোভকারীরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবনের কাচ ভেঙে দেয়, রাস্তায় গাড়ি উল্টিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফিলাডেলফিয়ায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর এবং মলোটভ ককটেল ছোড়ে। সান ফ্রান্সিসকোতে মুখোশ পরে কিছু লোক একটি বড় দোকানের দরজা ভেঙে ঢুকে লুটতরাজ করে।

মিনেপোলিসে আবার এক ট্রাক ড্রাইভার বিক্ষোভকারীদের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়েছে। এরপরই ট্রাকচালককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৭০০ জওয়ানকে নামানো হয়েছে। আর এই বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি বাড়াবাড়ির মুখে পড়ছেন সাংবাদিকরা। শুক্রবার সিএনএনের সাংবাদিক ও তার সঙ্গীদের বিক্ষোভের খবর লাইভ দেখানোর সময় গ্রেপ্তার করা হয়।

শনিবার কেনটাকিতে ‘ওয়েভ নিউজ’র এক সাংবাদিকের দিকে পিপার গান ছোড়ে পুলিশ। রয়টার্সের সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের গায়ে রবার বুলেট লেগেছে। গত তিনদিনে অন্তত দুই ডজন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। হাঁটু গেড়ে মাথা নত করে ক্ষমা চাইল পুলিশ মিনেসোটায় পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে যখন পুরো যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে, তখন প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নিউইয়র্ক ও মিয়ামির পুলিশ।

শনিবার নিউইয়র্কে বিক্ষোভ চলাকালে প্রতিবাদকারীরা হাঁটু গেড়ে বসে নীরবতা পালন করার সময় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। মিয়ামিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ৫০ জনের বেশি লোককে গ্রেফতার করলেও কয়েকজন পুলিশ সদস্য হাঁটু গেড়ে বসে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সংহতি জানান। নিউইয়র্কে পুলিশ কর্মকর্তাদের সংহতি জানানোর ভিডিও ধারণ করেছেন আলিয়া আব্রাহাম।

তিনি বলেন, ‘আমি এমনটি প্রত্যাশা করিনি। কখনও এমনটি দেখিনি’। ফ্লয়েডের মৃত্যু প্রতিবাদে বিক্ষোভ লন্ডন-বার্লিনেও এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নিপীড়নে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ঘিরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রোববার লন্ডন, বার্লিন এবং টোরান্টোর মতো শহরেও বিক্ষোভ করেছে শত শত মানুষ।

যুক্তরাজ্যে লন্ডন শহরের কেন্দ্রস্থলে ট্রাফালগার স্কোয়ারে ন্যায়বিচার এবং শান্তির দাবিতে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। জার্মানির বার্লিনেও কয়েকশ’ বিক্ষোভকারী যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে জর্জ ফ্লয়েডের ন্যায়বিচারের দাবিতে। ‘কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা’ বন্ধের দাবিতেও স্লোগান দেয় তারা। কানাডার টরেন্টো শহরেও চার হাজার বিক্ষোভকারী ফ্লয়েড হত্যা, বর্ণবাদ এবং পুলিশের উপস্থিতিতে স্থানীয় এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর মৃতু্যর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছে।

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ