বিএনপি এমপির ড্রাইভার ছিলেন! এখন হাজার কোটি টাকা, হেলিপ্যাডসহ প্রাসাদ!

কৃষকের ১০ বস্তা পেঁয়াজ চুরির অভিযোগে সালিসি বৈঠক করে গ্রামের লোকজন তাঁকে পিটুনি দিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিএনপি সমর্থিত এমপির ব্যক্তিগত গাড়িও চালিয়েছেন তিনি। আর ওই এমপির বদৌলতে হয়েছিলেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগার হয়ে যান। ১০ বছরের ব্যবধানে হয়ে যান হাজার কোটি টাকার মালিক।

গ্রামে টিনের ঘরের পরিবর্তে এখন হেলিপ্যাডসহ আলিশান বাড়ি। পাশাপাশি পাবনা সদর ও ঢাকার মিরপুরেও রয়েছে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিপুল পরিমাণ জমি। এই ব্যক্তিই হচ্ছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসিক ভবন নির্মাণের ঠিকাদার শাহাদাত হোসেন, যাঁকে সারা দেশের মানুষ এখন চেনে বালিশকাণ্ডের হোতা হিসেবে। শাহাদাত কারাগারে থেকেও নিজের সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে বাগিয়ে নিয়েছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ৮৭ কোটি টাকার কাজ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালে পাবনার মানিকহাট ইউনিয়নের উলাট গ্রামের পৈতৃক জমিতে আট কোটি টাকায় হেলিপ্যাডসহ নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। ওই বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরেই কিনেছেন ৩০ বিঘা জমি। ওই জমির বিঘাপ্রতি মূল্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা হলে ৩০ বিঘার দাম প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। একই গ্রামে কিনে ও দখলবাজি করে ৫৫ বিঘা জমির ওপর আটটি মাছের খামার করেছেন। জমি কেনা এবং মাছের খামারে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে কয়েক শ গজ দূরে শহরের সবচেয়ে দামি এলাকায় প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকায় কিনেছেন ১৯ কাঠা জমি। সেই জমিতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন ২০১৭ সালে। এই বাড়ির ছাদের ওপরেও আছে হেলিপ্যাড, আছে নান্দনিক সুইমিং পুলসহ আধুনিক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। এ ছাড়া ঢাকার মিরপুরে বিআরটিএর কার্যালয়ের পেছনে আছে একটি ছয়তলা ও একটি ১০ তলা অ্যাপার্টমেন্ট। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরো একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়িসহ উত্তরা, গাজীপুর, সাভারেও রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ।

পাবনার সুজানগরের মানিকহাট ইউনিয়নের উলাট গ্রামের রমজান শেখের ছেলে শাহাদাত হোসেন। একসময় উলাট-সুজানগর সড়কে সিএনজিচালক ছিলেন। ২০০০ সালের দিকে মানিকহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সুজানগর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শফিউল আলমের বাবার ক্ষেত থেকে ১০ বস্তা পেঁয়াজ চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছিলেন শাহাদাত। শফিউল আলম এ প্রসঙ্গে গতকাল  বলেন, ‘দেখুন সেটা অনেক আগের ঘটনা, চুরির পর তাঁর মামার উপস্থিতিতে বিচার হয়েছিল।’ এলাকার মানুষের জমি দখল নেওয়া প্রসঙ্গে শফিউল আলম বলেন, ‘জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বেশ কয়েকবার আমরা থানায় বসেছিলাম, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।’

শাহাদাত ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত এমপি সেলিম রেজা হাবিবের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তাঁর গাড়িও চালান। সেলিম রেজা হাবিব  বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর শাহাদাত আমার সঙ্গেই ছিল। সুজানগর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পর আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। এখন তো শুনি ঠিকাদারি করে কয়েক শ কোটি টাকার মালিকও বনে গেছে।’ আপনার গাড়ি নাকি চালাত শাহাদাত—এ প্রশ্নের জবাবে সেলিম রেজা বলেন, ‘দেখুন মাঝে মাঝে গাড়ি চালাত, এসব কথা এখন বলে কী লাভ?’

মানিকহাট ইউনিয়নের গাবগাছি গ্রামের আব্দুল জলিল, আব্দুল আলীম, ওহাব মিয়া, খন্দকার আব্দুল মোমেন, মো. ইউনুস, মোহনসহ অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তাঁদের জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়ে শাহাদাত মাছের খামার করেছেন। থানা, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে অভিযোগ করেও সেই জমি ফিরে পাননি। আব্দুল ওহাব বলেন, ‘আমাদের এক একর ৬০ শতাংশ জমি দখলে নিয়ে গেছে শাহাদাত। সেই জমিতে মাছের খামার করছে। প্রতিবাদ করায় আমার ওপর গুলিও চালিয়েছিল, অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। সুজানগর থানায় গিয়ে মামলার জন্য অনেকবার ঘুরলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।’ আব্দুল আলীম বলেন, ‘একসময় চুরির অভিযোগে মানুষ ধরে পিটাইছিল, সেই শাহাদাত হেলিকপ্টার নিয়ে এলাকায় আসে। আমরা গরিব মানুষ তাদের ক্ষমতার সঙ্গে পারি কিভাবে?’ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি আমলে এমপির গাড়ি চালাত, মানুষকে খুব অত্যাচার করত। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, এখনো সে আমাগো জমি দখলে নেয়, অত্যাচার করে।’

উলাট গ্রামে শাহাদাতের বাড়ির পাশেই হযরত আলীর বাড়ি। ৯ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত বাড়িতে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে থাকছে তাঁর পরিবার। সেই বাড়ি কিনে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালায় শাহাদাত। না পেরে পুলিশের সহযোগিতায় জোর করে দখলে নিয়েছিল শাহাদাতের লোকজন। হযরত আলী বলেন, ‘পুলিশ দিয়ে দখলে নেওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের মহযোগিতায় অনেক চেষ্টার পর বাড়িটি পুনরুদ্ধার করি। এখন আতঙ্কে আছি জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে আবার বাড়ি দখলে নিয়ে যায় কি না।’

শাহাদাত ৪৫ বিঘা ফসলি জমিতে মাছের খামার করায় আশপাশের প্রায় সাড়ে তিন শ বিঘা জমির মালিক রয়েছেন বিপাকে। মাছের খামারের কারণে তাঁদের জমিও ১২ মাসই পানিতে ডুবে থাকে। ধান, পেঁয়াজ চাষ করা যাচ্ছে না। থানা পুলিশ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে আবেদন করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগ, এভাবে পানিতে ডুবিয়ে কম দামে ওই জমি কেনার পাঁয়তারা করছে শাহাদাতের লোকজন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের সাবেক জিএস খন্দকার জাহাঙ্গীর কবীর রানা বলেন, ‘শাহাদাত হোসেনের মাছের খামারের জন্য আমার ১০ বিঘা জমিতে সব সময় পানি জমে থাকে। কয়েক শ কৃষক আর ফসল ফলাতে পারে না। অনেকের জমি দখল করে মাছের খামার করলেও তাঁর ভয়ে গ্রামের নিরীহ মানুষ কিছু বলতে পারে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহাদাতের পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন ও সাখাওয়াত হোসেন বিএনপির আঞ্চলিক নেতা। সাজ্জাদ হোসেন পাবনা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। সুজানগর থেকে গত নির্বাচনে ধানের শীষের প্রতীক পেতে মাঠে প্রচারণাও চালিয়েছিলেন সাজ্জাদ।

জানা গেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শাহাদাত হয়ে যান আওয়ামী সমর্থক ঠিকাদার। ঢাকায় এসে পরিচয় হয় কথিত যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের সঙ্গে। জি কে শামীম ও গণপূর্তের প্রভাবশালী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিল্লুর রহমানের হাত ধরে এগিয়ে যান তরতর করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ‘গ্রিন সিটি’ প্রকল্পে তাঁর সাজিন এন্টারপ্রাইজ সাতটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ পায়।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ