বিএনপির দুই নেতার পকেটে স্বাস্থ্যখাতের লাখ লাখ টাকা

ঝিনাইদহে স্বাস্থ্য খাতের বিশেষ অনুদানের লাখ লাখ টাকা বিএনপির দুই নেতার পকেটে চলে গেছে। স্বনামে-বেনামে তাদের একাধিক এনজিও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুদানের টাকা গায়েব করেছে।

ঝিনাইদহ জেলা কৃষক দলের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক অনোয়ারুল ইসলাম বাদশা ও সদর পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সাহাজান আলী ভুয়া ও জাল কাগজপত্র দিয়ে তাদের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে অনুদানের টাকা তুলে নিয়েছেন।

তবে এসবের নাটের গুরু জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সিসিটি (কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান) হাবিবুর রহমান। ভুয়া প্রকল্প, কাগজপত্র, আবেদন সবকিছু করে দেন তিনি। এদিকে অনুদানপ্রাপ্ত ভুয়া এনজিওগুলোর কাছে ফোন করে পিপিই ও মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে ৫৪টি এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে ৫৪টি এনজিও’র অনুকূলে অনুদান দেয়া হয়েছে। জুনের বিভিন্ন তারিখে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে চেক গ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের দায়িত্বশীল একটি

সূত্র জানায়, সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম ৫৩টি এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপপরিচালক ডা. জাহিদ হোসেন ৫২টি এনজিও’র ভুয়া বিল ভাউচার অনুমোদন দিয়েছেন। এর মধ্যে একই এনজিও উভয় বিভাগ থেকে অনুদানের অর্থ পেয়েছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। বিএনপির এক নেতা জাল কাগজপত্র দিয়ে একই প্রতিষ্ঠানের নামে দুইবার অনুদানের টাকা তুলেছেন।

জেলা কৃষক দলের সাবেক সভাপতি বাদশার এনজিও নাম ঝিনাইদহ জেলা বাউল সমিতি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে বাউল সমিতি। জেলা হিসাবরক্ষণ দফতর থেকে ১১ জুন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাদশা চেক গ্রহণ করেন। সেভ ঝিনাইদহের পরিচালকের সিল দিয়ে ৯ জুন ৫০ হাজার এবং ঠিকানা পরিবর্তন করে একই (সেভ) নামে সাধারণ সম্পাদকের ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর করে বাদশা ৫০ হাজার টাকার চেক গ্রহণ করেন।

২৮ জুন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা তিনি তুলেছেন। সরাসরি ও ফোনে বাদশা বলেন, প্রথমবারের মতো মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে তিনি বরাদ্দ পেয়েছেন। টাকা কী করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিভিল সার্জন কিছু জিনিসপত্র চেয়েছেন। পাঁচ হাজার টাকায় সেগুলো কিনে দেব।

সদর পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাজানের এনজিওর নাম সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে এনজিওটির নামে তিনি ৭৫ হাজার টাকার অনুদান নিয়েছেন।

বরাদ্দের টাকা দিয়ে স্বাস্থ্যসেবার কাজ করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে ২৪ জুন সাহাজানের ম্যানেজার আশিষ মৌলিক একাই স্বাক্ষর করে ১১টি এনজিও’র বিল ভাউচার বুঝে নিয়েছেন।

সাহাজান আলী  জানান, ফেডারেশন অব এনজিও ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) সভাপতি তিনি। মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ আনতে টাকা-পয়সা খরচ করে হয় বলে তিনি দাবি করেন। শহরের কবি গোলাম মোস্তফা সড়কে সাহাজানের রয়েছে আল মামুন জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতাল হলেও এনজিও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠানটির নামে ৫০ হাজার টাকা তিনি অনুদান নিয়েছেন।

সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম জানান, জেলায় কয়েকটি ভালো এনজিও রয়েছে। তবে অনুদানপ্রাপ্ত বেশির ভাগ এনজিওই নামসর্বস্ব। বরাদ্দের টাকা দিয়ে কোনো কাজই করে না এনজিওগুলো। এ কারণে পিপিই ও মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী চাওয়া হয়েছে বলে তিনি যুক্তি দেখান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসবের নাটের গুরু জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সিসিটি (কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান) হাবিবুর রহমান। ভুয়া প্রকল্প, কাগজপত্র, আবেদন সবকিছু করে দেন তিনি। চেক হাতে আসা মাত্র কমিশনের ২০% ভাগ অথবা ৩০% ভাগ সিন্ডিকেটের সদস্যদের হাতে গুনে দিতে হয়। গায়েবি এনজিওকে অগ্রিম কমিশনের টাকা বুঝে দিতে হয়।

হাবিবের ভাতিজা আজম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। অনুসন্ধানে চাচা-ভাতিজার কমিশন বাণিজ্যের খবর বেরিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে কাগজপত্র তৈরিসহ বরাদ্দ প্রদানের চুক্তি করতে হয়।

কমিশন যত বেশি বরাদ্দও তত মোটা অংকের হবে। স্ত্রী আসিয়া খাতুনের নামে একটি এনজিও রয়েছে বলে হাবিব স্বীকার করেছেন। স্রোতধারা সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামের ওই এনজিও গত অর্থবছরেও ৭৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে।

অথচ জেলা শহরের শহীদ মশিউর রহমান সড়কে ওই নামে কোনো এনজিও অফিস নেই। এমন অসংখ্য ভুয়া এতিমখানা, মহিলা সমিতি, এনজিও রয়েছে- যাদের না আছে অফিস, না আছে সাইনবোর্ড, না আছে কর্মচারী। অথচ প্রতি বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ থেকে অনুদান পাচ্ছে সংস্থাগুলো। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কমিশন বাণিজ্য বন্ধ না হলে গায়েবি এনজিও’র অনুদান বন্ধ হবে না।

 

সুত্রঃ যুগান্তর