বিআরটিসিকে দুর্নীতিমুক্ত করুন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশে সড়কপথে গণপরিবহনের সার্বিক চিত্র অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। এই বিশৃঙ্খলা এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার উচ্চ হারের অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয়, সড়কপথে মানুষের চলাচলের গতিও মন্থর, ঝামেলাপূর্ণ, প্রায়ই দুর্ভোগময়। গণপরিবহনের এ খাতের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) নামের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবসায়িক আধিপত্য বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোর হাতে। মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের ব্যাপকতর ভূমিকা ও তার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করে না, কিন্তু রাষ্ট্রীয় খাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও প্রত্যাশা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিআরটিসি সেই প্রত্যাশা পূরণ থেকে সব সময়ই অনেক দূরে রয়ে গেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থার অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দায়িত্ব পালনে অবহেলার প্রবণতা কত ব্যাপক, তা মোটের ওপর সবারই জানা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের সুবাদে বিষয়টা আবারও সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হলো। গত সোমবার বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মন্ত্রী বলেন, বিআরটিসির বাসগুলো নোংরা, শ্রীহীন; সেগুলোর কোনো যত্ন নেওয়া হয় না। রং চটে গেছে, বডি আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। সিট নেই, ফ্যান নেই, ইত্যাদি। মন্ত্রীর এই কথাগুলো যেন প্রতীকীভাবে বিআরটিসি নামক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির দুর্দশাই তুলে ধরে। দুর্দশার কারণ নিঃসন্দেহে অব্যবস্থাপনা এবং অব্যবস্থাপনার পেছনে আছে অদক্ষতার পাশাপাশি পদ্ধতিগতভাবে অনৈতিকতার চর্চা। বিআরটিসিতে দুর্নীতি একটা স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে—এ কথা মন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ সংস্থায় চেয়ারম্যান আসে আর যায়। আসার সময় শুনি সৎমানুষ, কিছুদিন পরেই দেখি নানা অভিযোগ। ডিপো ম্যানেজারদের নিয়ে তিনিও দুর্নীতি-অনিয়মে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন।’

বিআরটিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাম্প্রতিক অভিযোগের খবর হলো, ভারত থেকে কেনা ৬০০টি দোতলা ও একতলা বাস সংস্থাটির যানবহরে যুক্ত হতে না হতেই ধরা পড়েছে নানা রকমের ত্রুটি। সেগুলোর কোনোটার ছাদে ফুটো, কতকগুলোর টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে ঠিক নেই। নতুন বাসের ছাদে ফুটো ধরা পড়লে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেগুলো কি আসলেই নতুন? নাকি পুরোনো, ব্যবহৃত এমনকি পরিত্যক্ত বাসগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে রং লাগিয়ে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের হাতে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে? সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, বিআরটিসির যেসব কর্মকর্তা ওই সব বাসের চালান গ্রহণ করেছেন, তাঁরা কি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাসগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছিলেন? মন্ত্রী বলেছেন, বিআরটিসির যেসব কর্মকর্তা এসব বাস কেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কোনো অবহেলা বা অনিয়ম ছিল কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে।

বিআরটিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এবারই প্রথম উঠল এমন নয়। সংস্থাটিতে দুর্নীতি যে স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে, তা মন্ত্রীর বক্তব্যেই পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। বিআরটিসি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা। সুতরাং সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তা প্রতিকারের দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এড়াতে পারেন না। সেদিন মন্ত্রী বলেছেন, যারা অনিয়ম, অপকর্ম ও দুর্নীতি করবে; যতই অভিজ্ঞ হোক, তাদের বিআরটিসিতে প্রয়োজন নেই। লক্ষণীয় বিষয় হলো মন্ত্রীর এই বক্তব্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার হুমকি আছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপ করা যে ফৌজদারি অপরাধ এবং সে জন্য বিচার ও শাস্তির বিধান আছে, এ কথা ঊহ্য রয়ে গেছে।

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই বলা হয় তদন্ত করা হবে। কিন্তু তদন্ত, বিচার, শাস্তির খবর আর পাওয়া যায় না। ফলে জবাবদিহির বাইরে শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা পুরোনো ব্যাধির মতো হয়ে ওঠে। বিআরটিসিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সে জন্য কঠোর জবাবদিহি ও দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।