বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী প্রামাণিক জুয়েলার্স

নিজস্ব প্রতিবেদক:
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পূর্বেই নগরীর মালোপাড়া এলাকায় স্বর্ণলংকারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন রাজশাহীর নিত্যানন্দ প্রামানিক। সে সময় ছোট একটি টেবিল, একটি গদি আর একটি সিন্দুকের মাধ্যমে নগরীর মালোপাড়া এলাকায় ব্যবসায় পরিচালনা করতেন নিত্যানন্দ প্রামানিক ও তার ঠাকুর কাকারা। এরপর থেকে ধীরে ধীরে প্রসার ঘটে তাঁদের ব্যবসায়। সে সময় ব্যবসায়ের মূল গ্রাহক ছিলেন কৃষক শ্রেণী। কৃষকরা জমির নতুন ধান বিক্রি করে সে অর্থ চুরি বা লুট হওয়ার ভয়ে স্বর্ণালংকার বানাতেন। আবার নতুন ফলনের জন্য সে স্বর্ণ পুনরায় বিক্রি করতেন। এভাবেই ক্রমাগত ব্যবসার প্রসার ঘটান নিত্যানন্দ প্রামানিক।

নিত্যানন্দ প্রামানিকের পর এ ব্যবসায়ের হাল ধরেন ছেলে রসময় প্রামানিক। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সবাই যে যার মতো দেশ ত্যাগ করে অথবা নিরাপদে আশ্রয় নেন। যুদ্ধের পর শখের দোকান ‘প্রামানিক জুয়েলার্সে’ এসে রসময় প্রামানিক দেখেন, দোকানটি পুরোই ভেঙ্গে চৌচির হয়ে আছে। নেই সিন্দুকের গহনাগাটিও। ফলে ব্যবসাও গুটিয়ে ফেলতে হয় তাঁকে। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে কিছুদিন পরে মারাও যান তিনি।

রসময় প্রামানিকের মৃত্যুর পর প্রামানিক জুয়েলার্সের দায়িত্ব নেন ছেলে শংকর প্রসাদ প্রামানিক। তিনি তাঁর বাবার হারানো ব্যবসাকে পুনরায় চালু করেন। বাড়ি থেকে মহিলাদের সোনার অলংকারগুলো নিয়ে আসেন। এরপর সেই অলংকারকে পূজি করে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। ততদিনে এই অঞ্চলে সোনার ব্যবসার প্রসার ঘটে। প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে শঙ্কর প্রসাদ প্রামানিকের মৃত্যূ হয় ১৯৯২ সালের ৯ ডিসেম্বর। মৃত্যূকালে রেখে যান ৭ ছেলে। এর মধ্যে সুকুমর প্রামানিক, রবীন্দ্রনাথ প্রামানিক এবং সত্যজিৎ প্রামানিক তিনজন প্রামানিক জুয়েলার্সের ব্যাবসা পরিচালনা করে আসছেন।

সুকুমর প্রামানিকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এই জুয়েলারী ব্যবসা আমাদের পূর্ব পুরুষেরা করে গেছেন। তাদের পরম্পরা আর সুনাম ধরে রাখার জন্য আমরা এখনও এই ব্যবসা করে যাচ্ছি। ৯২ সালের পূর্বে রাজশাহীতে কোনো স্বর্ণের দোকানে ‘এসি’ ছিল না। আমরাই প্রথম স্বর্ণের দোকানে ডেকোরেশন করি। আমরাই সোনার তৈরী বিভিন্ন গহনা সাজানোর ব্যবস্থা করি। পরবর্তীতে বিভিন্ন দোকানে প্রচলন হয়ে উঠে এই প্রচলন রাজশাহীতে।

প্রামাণিক জুয়েলার্স
ছবি: সালাহ উদ্দিন

সুকুমর প্রামানিক বলেন, ‘পূর্বে কৃষকরাই ছিলেন এ ব্যবসার মূল গ্রাহক। সে সময় কৃষকরা জমির ফসল ফলিয়ে গহনা বানাতো আবার গহনা বিক্রি করে ফসল ফলাতো। বলা যায় সোনার সাথে জমির অর্ন্তবর্তী লেনদেন সম্পন্ন হতো। বিশেষ করে ধানকে সোনার সঙ্গেই তুলনা করা হতো। পূর্বে বিয়ের জন্য মেয়েকে সোনা দিয়ে বাসায় আনতে হতো। যার ফলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় অনেক আগে থেকেই মেয়ের জন্য গহনা তৈরী করার প্রয়োজন পড়তো।

সে সময় কারিগরেরা সোনার তৈরী মাকড়ি, হাসুলি, তাবিজ, পদক, কাটাই মালা, নকশী মালা, কানের মাকুলি, ঘটি দুল, পায়ের তোড়া, নোলক, মন ইত্যাদি তৈরি করতো। কিন্তু আধুনিকতার ছোয়ায় এসব জিনিস এখন হারিয়ে গেছে। মানুষের রুচি ও চোখের চাহিদার ভিন্নতায় নিত্য নতুন ডিজাইন দিয়ে তৈরী হচ্ছে অলংকার। আর আধুনিকতার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে চাহিদা বাড়ছে স্বর্ণের । সেই সাথে নিজেই জুয়েলারি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন অনেক কারিগররা। যদিও পূর্বে একটি দোকানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন কারিগর কাজ করতো। কিন্তু বর্তমানে কারিগরেরা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে নিজেরা বিভিন্ন দোকানের অর্ডার নিয়ে তা তৈরী করছেন। ফলে এখন কারিগরের সঙ্কট চলছে বেশ।’

সোনার মূল্য বৃদ্ধি, আধুনিক এমিটেশন জুয়েলারীর আগমন আর স্বর্ণ ব্যবসার প্রসারতার কারণে পূর্বের ন্যায় ব্যবসা ভাল নেই বলেও জানান তিনি। প্রতিযোগীতার বাজারে যারা বিশ্বাসযোগ্য তাদের ব্যবসা এখনো টিকে আছে। এ কারণে আগের চেয়ে এখন কিছুটা ভাটা থাকলেও এইকেবল শততা আর সুনামের কারণে বংসপরম্পরায় এগিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর এই ঐতিহ্যবাহী ‘প্রামানিক জুয়েলার্স’।