শনিবার , ৩১ আগস্ট ২০২৪ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

বাদাম বিক্রেতা থেকে ৫০০ কোটির মালিক শাহু: বাপ-বেটা মিলে ত্রাসের রাজত্ব

Paris
আগস্ট ৩১, ২০২৪ ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

এক সময় ছিলেন বাদাম বিক্রেতা। কখনো ভবঘুরে, আবার কখনো টোকাই নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। পড়া-লেখাও করেননি। থেকে গেছেন স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হিসেবে। পরের জমিতে কাজও করতেন কখনো কখনো। সেই তিনি জমির দালালি করতে গিয়ে পেয়ে জান আলাদিনের চেরাগ। একসময় নিজেই হয়ে উঠেন ভূমিদস্যূ। টাকার জোরে এলাকায় কাউন্সিলরও নির্বাচিত হোন তিনবার। তাঁর এলাকায় তাঁকে ভোট দিতে না চাইলে সেই পরিবারে নেমে আসত অত্যাচার-নির্যাতন বা হয়রানির খড়গো। সেই কাউন্সিলরকে নিয়ে এর আগেও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদক মামলাও করেছেন। কিন্তু এসবকে পাত্তা না দিয়ে বরাবরই তিনি ছিলেন দাপটে।

সেই তিনি হলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহু। এই শাহুর সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে সনি হোসেনও এলাকায় চাঁদাবাজ নামে পরিচিত। তবে গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাপ-ছেলে দুজনই এলাকা ছাড়া। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শাহুর ব্যক্তিগত কার্যালয় ভাংচুরসহ তাঁর টাইলস ও রড-সিমেন্টের দোকানে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটও চালায়।

এলাকাবাসীর অভিযোগটাইলস ও রড-সিমেন্টের ব্যবসা দেখেন শাহুর বড় ছেলে সনি। সনির এই দোকান থেকে বাজার দরের চেয়ে বেশি মূল্যে টাইলস ও রড সিমেন্ট না কিনলে ওই এলাকায় কেউ সুষ্ঠভাবে বাড়ি নির্মাণের কাজ করতে পারবেন না। ওই জায়গা দখল করা হয়, না হলে থানায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সেই জমির মালিককে নানাভাবে হয়রানি করে বন্ধ করে দেওয়া হয় কাজ। এভাবেই বাবার ক্ষমতার দাপটে ছেলে সনিও করেছেন রাজত্ব। একদিকে বাপ শাহু মানুষের জমি দখল করে বানিয়েছেন অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ। আরেকদিকে ছেলে ব্যবসার নামে মানুষকে হয়রানি করে চাঁদাবাজি করে হয়েছেন কোটিপতি। সেই টাকার দাপটে বাপ-বেটা মিলে এলাকায় কায়েম করেন ত্রাসের রাজত্ব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের জুনে অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) নির্বাচনে চতুর্থ বারের মতো অংশ নেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহু। হলফ নামাতেও তিনি স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন উল্লেখ করেন। হলফ নামায় স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন শাহু’র নগদ টাকা ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা ছিল বলে উল্লেখ করেন। যাকে বলা যায়, টাকার পাহাড়ে বসেছিলেন তিনি। আর বাৎসরিক আয় দেখানো হয় প্রায় এক কোটি টাকা। ব্যাংকে জমা দেখানো হয়েছিল প্রায় তিন কোটি টাকা।

দুদক সূত্র মতে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহুর বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই অভিযোগে তাঁর স্ত্রী নাজমা আলীর বিরুদ্ধেও আলাদা আরেকটি মামলা করা হয়। দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ে দুজনের বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করা হয়। দুদকের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন।

দুদক জানিয়েছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়ে কাউন্সিলর শাহু ও তার স্ত্রী নাজমা আলীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। একপর্যায়ে দুজনকে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে কাউন্সিলর শাহু তার নামে ৯ কোটি ৬৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫০৪ টাকার এবং নাজমা তার নামে ১ কোটি ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার ৩৭৬ টাকার সম্পদ দেখান। এছাড়া শাহুর সম্পদ হিসেবে দেখান, একটি প্যারাডো জিপ গাড়ী, একটি পিস্তল, ২১ বিঘা জমি ও আটটি বাড়ির মালিক তিনি। এর মধ্যে নিজের নামে ৫টি এবং স্ত্রীর নামে ৩টি বাড়ি। নিজের নামে ৫টি বাড়ির মধ্যে তিন তলা একটি, ৫ তলা বাণিজ্যিক ভবন একটি, তিন তলা আবাসিক একটি, ৫ তলা আবাসিক একটি এবং দুই তলা আবাসিক দুটি। স্ত্রীর নামে তিনটির মধ্যে রয়েছে ৬ তলা আবাসিক একটি এবং নির্মাণাধীন ৫ তলা ও ১০ তলা দুটি।

তবে অনুসন্ধানে দুদক শাহু ওতাঁর স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের খুঁজে পায়। মামলায় উল্লেখ করা হয়, শাহুর নামেই ১১ কোটি ৯৩ লাখ ১৫ হাজার ৫০৪ টাকার এবং তার স্ত্রী নাজমা আলীর নামে ২ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৬ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ আছে। এক্ষেত্রে শাহু ২ কোটি ২৪ লাখ ৬২ হাজার এবং তার স্ত্রী নাজমা ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ২৪৯ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন।

দুদক আরও জানায়, মোট সম্পদের মধ্যে কাউন্সিলর শাহুর ৭ কোটি ২৮ লাখ ৫১ হাজার ৫০৩ টাকার সম্পদই তার আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। আর তাঁর স্ত্রীর আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ আছে ১ কোটি ৬ লাখ ৬ হাজার ৯২৬ টাকার। অর্থাৎ মোট সম্পদের বড় অংশই তারা অবৈধ পন্থায় অর্জন করেছেন।

জিয়াউল হক নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমরা দেখেছি শাহু আমাদের বাড়িতে গরুর রাখালি করত। এখন সে শত শত কোটি টাকার মালিক। কিভাবে একজন অশিক্ষিত মানুষ কিভাবে এতো টাকার মালিক হলো? আওয়ামী লীগের দাপটে সে এলাকায় যা খুশি করেছে। তার এখন একশ  বিঘারও বেশি সম্পত্তি। সিটি করপোরেশনের প্রকল্পের টাকা নিয়ে এসে নিজের আবাসিক প্রককল্পের রাস্তাও করেছে। কিন্তু তার দাপটে কেউ ভয়ে কথা বলার সাহস পায়নি। যারাই প্রতিবাদ করতে গেছে, তারাই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে।

এদিকে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র মতে, দুদকের এই মামলার পরে শাহু তাঁর নামে থাকা নগরীর সিলিন্দা এলাকায় রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে জমি অধিগ্রহণ বাবদ একদিনেই ৮১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সরকার তাঁর জমির দাম বাবদ ওই টাকা পরিশোধ করেছে।

স্থানীয় আব্দুল হালিম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘শাহু যে সম্পদ গত ২০ বছরে গড়েছেন-তা কোনো মতেই ৫০০ কোটি টাকার নিচে হবে না। তাঁর রাজশাহী শহরে যে ৮টি বাড়ি আছে, সেই বাড়িগুলোর দামই অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। এর বাইরে নিজেরসহ স্ত্রী ও দুই ছেলের নামে নামে-বেনামে রয়েছে অন্তত অন্তত ১০০ বিঘা জমি। এই জমির দাম হবে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা। অথচ এই শাহু ছোটকালে এলাকায় টোকাই বা ভবঘুরে ছিল। একটু বড় হওয়ার পরে বাদাম বিক্রি করত। তার পরে সাইকেল মিস্ত্রিও ছিল। সেই শাহু বছর পঁচিশেক আগে এলাকায় জমির দালালি শুরু করে। এর পর নিজেই জমির ব্যবসা করে। তখন থেকেই এলাকার কিছু মাস্তানকে হাত করে মানুষের জমি দখল শুরু করে শাহু।’

নওদপাড়া এলাকার আজিজুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘বিবাদমান জমিগুলোর দিকে ছিল শাহুর নজর। যেখানেই জমির বিবাদ ছিল, সেখানেই হাত দিয়ে মীমাংসার নাম করে অল্প টাকা দিয়ে জমি কিনে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করায় শাহুর মূল ব্যবসা ছিল। মীমাংসা না হলে সেই জমি নিজেও দখল করত শাহু। কাউন্সিলর হওয়ার পরে তাঁর রাজত্ব বৃদ্ধি পায় আরও। মানুষের জমি দখল বা মীমাংসার নাম করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে এই শাহু।’

একই এলাকার ইখতেয়ার আলী নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, শাহুর ছেলে সনিও দখলবাজিতে কম নয়। তাঁর দোকান থেকে টাইলস, রড-সিমেন্ট না কিনলে কেউ বাড়ির কাজে হাত দিতে পারে না। আমি তাঁর দোকান থেকে উচ্চ দামে রড সিমেন্ট না কিনতে চাওয়ায় আমার জমিটিও দখলের পায়তারা করেছিল। থানায় অভিযোগ দিয়েছিল আমার নামেই। পরে অনেক কাঠ-খোড় পোয়ানোর পরে আমি শেষ পর্যন্ত বাড়ির কাজ শুরু করে।’

নাজমুল নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমারা ১৭ জন মিলে একটি জমি কিনে। একদিন দেখি আমাদের সাইন বোর্ড নাই। সেখানে কাউন্সিলর শাহুর নামে সাইনবোর্ড দেওয়া। পরে থানা পুলিশের সহযোগিতায় বেশকিছু টাকা গোচ্চা দিয়ে শাহুর সেই সাইনবোর্ড সরানো হয়। এর পর আমরা বাড়ির কাজে হাত দিতে পারি। এভাবে জমি দখলই ছিল শাহু এবং তার ছেলের মূল ব্যবসা।’

স/আর

 

সর্বশেষ - রাজশাহীর খবর