বাণিজ্যিক উৎপাদনে ফিরছে ঐতিহ্যবাহী ‘ঢাকাই মসলিন’

আমজাদ হোসেন শিমুল:

একসময় মিহি সুতিবস্ত্র ‘ঢাকাই মসলিনের’ রাজত্ব ছিল আকাশচুম্বি। কথায় আছে- ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত। আবার ৬-৭ তোলা ওজনের যেটি লম্বায় ১০ গজ ও প্রস্থে ১ গজের একটি মসলিন কাপড় ছোট্ট একটা আংটির মধ্যে দিয়ে নাড়াাচাড়া করা যেত। কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এই ‘ঢাকাই মসলিন’। তবে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রায় ১৭০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫০ সালে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের সাক্ষী ‘ঢাকাই মসলিন’ এর পুনর্জন্ম ঘটেছে। দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষকের ছয় বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তৈরী হয়েছে ‘মসলিন শাড়ী’।

রাবির উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মাঠে দেশের ৯টি স্পট থেকে সংগৃহিত ৩৯ ধরনের ফুটি কার্পাস তুলার গাছ লাগানো হয়েছে

শুধু তাই নয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঐতিহ্যবাহী ‘ঢাকাই মসলিন’ এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্টরা গাজীপুরের কাপাশিয়ায় শীতলক্ষা নদীর তীরে এই কাপড় তৈরীর বাণিজ্যিক কারখানা নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছেন। এরই মধ্যে ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদনও পাওয়া গেছে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এ–সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। তাঁর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ আলীমুজ্জামান, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান, বিটিএমসি ঢাকার মহাব্যবস্থাপক মাহবুব-উল-আলম, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক এ এস এম গোলাম মোস্তফা ও সদস্যসচিব করা হয় তাঁত বোর্ডেও জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে স্থান দেয়া হয়।

পরে গবেষণাকাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে যুক্ত করা হয়। তাঁরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুলবন ওসমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম ফিরোজ আলম, অ্যাগ্রোনমী এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী ও বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রাজশাহীর গবেষণা কর্মকর্তা মো. আবদুল আলিম।

কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল- তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক করা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী।

কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। কাজেই প্রকল্পটির প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। তুলার গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত করা। অন্যটি খাঁটি মসলিন কাপড় সংগ্রহ।

গবেষণা কাজটি সম্পন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষক দল। তাদের ছয় বছরের চেষ্টা আর গবেষণা অবশেষে আলোর মুখ দেখেছে। তারা তৈরি করেছেন মসলিনের এগারোটি শাড়ি। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন গবেষকরা। কিন্তু শুরুতে এক টুকরা ‘অরিজিনাল’ মসলিন কাপড় জোগাতে কলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত ছুটেছেন গবেষক দল। অবশেষে লন্ডনের ‘ভিক্টোয়ান আলবার্ট মিউজিয়াম’ থেকে ‘অরিজিনাল’ মসলিন কাপড় সংগ্রহ করা হয়।

আর মসলিন বোনার সুতা যেই ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার গাছ থেকে তৈরি হয়, সেই গাছ খুঁজে বের করা হয়েছে বিচিত্র সব পন্থা অবলম্বন করে। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে এসেও এই শাড়ি তৈরিতে তাঁতিদের হাতে কাটা ৫৫৬ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়েছে। কাপড়ও বোনা হয়েছে হস্তচালিত তাঁতেই।

সম্প্রতি প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের সাক্ষাতে হয়। তিনি বলেন, ‘মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই আমাদের প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা ছিল না। ফুটি কার্পাসও ছিল না। কিন্তু আমাদের আত্মবিশ^াস ছিল- যেহেতু এক সময় মসলিনের উৎপাদন হতো তাই এগুলো আমরা খুঁজে বের করতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ধারণা থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাবির চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনেও। অবশেষে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকদল গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; রাজশাহী, বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৯টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কা- ও ফুল। গবেষকেরা মূল্যায়ন করে কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে ফুটি কার্পাসের মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাবির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়। পরে এখান থেকে তুলা সংগ্রহ সেই তুলা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে পাঠানো হয়।’

মসলিন কাপড় কীভাবে তৈরী করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এ সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ৫৫৬ কাউন্টের সুতা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন, যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর লেগে যায়। অবশেষে নারায়ণগঞ্জে দুইজন তাঁতির সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু এতো মিহি সুতা দিয়ে তারা কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করেন। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখ পর্যন্ত মোট ১১টি শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। আর শাড়ী তৈরী হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। বরাদ্দের ৩০ শতাংশ অর্থ দিয়েই আমরা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেয়া হয়েছে। আমাদের দায়িত্ব ছিল প্রকৃত মসলিন পুনরুদ্ধার করে কাপড়ের বুনন পর্যন্ত করা। আমরা সেটি করতে সক্ষম হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হবে। হয়তো আগামী মার্চ মাসের পর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। আর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়টা হবে বাণিজ্যিকভাবে ‘ঢাকাই মসলিনের’ উৎপাদন শুরু করা। এই নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকার বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করেছে। প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যানও তৈরী হয়ে গেছে। এছাড়া ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। মসলিনের পাঁচটি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। আশা করছি অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেই স্বীকৃতিও পেয়ে যাবে।’

প্রকল্পের মুখ্য এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা গবেষণায় যেটি পেয়েছি, গাজীপুরের কাপাশিয়ার শীতলক্ষা নদীর দুই ধারে এই ফুটি কার্পাস তুলার চাষ বেশি হচ্ছে। তাই প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে কাপাশিয়ায় জায়গা নিয়ে মসলিনের একটি স্থায়ী কারখানা বা মসলিন সেন্টার তৈরী করার জন্য সরকার চিন্তাভাবনা করছে। সেখানে যারা তুলা চাষ করবে, সুতা কাটবে, শাড়ী বানাবে তাদের ট্রেনিং দেয়া। সেই সাথে বেসরকারি খাতকে এর সাথে যুক্ত করা। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের বাজেট তৈরীর কাজও হয়ে গেছে। শুধু অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী জানিয়েছেন।’

এএইচ/এস