বাঘা-চারঘাটে স্থানীয় নির্বাচনে কী কারণে নৌকা হারে?

গেলো কয়েক বছর ধরে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পরাজয় দেখছে রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাট উপজেলা। এবারের পৌরসভা নির্বাচনেও সেই চেনা চেহারা দেখা গিয়েছে আবার। সবশেষ বাঘার আড়ানী পৌর নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হেরেছেন দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’র কাছে।

সরকারদলীয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মতে, পরপর তিনবার জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জিতলেও তার ধারাবাহিকতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরে রাখা যায়নি তৃণমূলের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে। সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের সবগুলো ধাপে দেশজুড়ে নৌকার জয়জয়কার হলেও ব্যতিক্রম আড়ানী। এর পেছনে দলটির স্থানীয় পর্যায়ে বিভক্তিকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।

আড়ানীতে এবারের বিজয়ী মুক্তার আলী দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেন। তিনি পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এবার নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন পেলেও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুজ্জামান শাহিদ মুক্তারের কাছে ১ হাজার ৬০৪ ভোটে হেরেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাঘার এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘এখানে অন্য দলের শক্তির কাছে আমাদের পরাজয় হয়নি। আমরা হেরেছি নিজেদের বিভক্তি আর দ্বন্দ্বের কাছে। কারণ আড়ানীতে দলীয় আর বিদ্রোহী দুই প্রার্থীর পাওয়া ভোট যোগ করলে যা দাঁড়ায়, তার মাত্র দশভাগের একভাগ মতো ভোট পেয়েছেন বিএনপি প্রার্থী।’

নির্বাচনে যাকে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ বলা হচ্ছে, সেই স্বতন্ত্র প্রার্থী মুক্তার আলী নারিকেল গাছ প্রতীকে ৫ হাজার ৯০৪ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শহিদুজ্জামান শাহিদ নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৪ হাজার ৩০০ ভোট। আর বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তোজাম্মেল হক ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ২৭৬ ভোট। আড়ানীতে মোট ভোটার ছিলেন ১৩ হাজার ৯৮৪ জন।

নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, পৌরসভার ৯টি কেন্দ্রের মধ্যে নৌকার প্রার্থী সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন জয়গুননেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। মোট ১ হাজার ৭০০ ভোটারের মধ্যে এখানে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৭৭ ভোট। এই কেন্দ্রে যে বিএনপির প্রার্থীর অবস্থাও শোচনীয়। তিনি পেয়েছেন মাত্র ৯৫ ভোট। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া ছাত্রলীগ নেতা রিবন আহমেদ বাপ্পী এই কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৩১ ভোট পেয়েছেন। বাকি ৮ কেন্দ্র মিলিয়ে তিনি পেয়েছেন ৫৪ ভোট। এখানে ১ হাজার ১৯৫ ভোট পেয়েছেন ‘বিদ্রোহী’ মুক্তার আলী। এই একটি কেন্দ্রেই পরাজয়ের ব্যবধান নির্ণায়ক ভোট হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী শাহিদ।

এর আগে ২০১৭ সালে বাঘা পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আবদুর রাজ্জাকের কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আক্কাছ আলী। বাঘা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুল আলমকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জামায়াত নেতা জিন্নাত আলী। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু নির্বাচিত হয়েছেন।

এদিকে ২০১৫ সালে চারঘাট পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নারগিস খাতুন ১৩৭ ভোটে পরাজিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী জাকির ইসলাম বিকুলের কাছে। ওই নির্বাচনে যুবলীগের এক নেতাও প্রার্থী ছিলেন। আর এ কারণেই হেরে যান নৌকার প্রার্থী। চারঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদের কাছে হেরেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ফকরুল ইসলাম। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অবশ্য তিনি চাঁদকে পরাজিত করেছেন।

দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, চারঘাট উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) রয়েছে। এর মধ্যে চারটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের নেতা। দুটির চেয়ারম্যান বিএনপির নেতা। বাঘায় সাতটি ইউপির মধ্যে পাঁচটিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা। অন্যটিতে বিজয়ী বিএনপির প্রার্থী। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে অবস্থান মোটামুটি ভাল হলেও পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদে ধাক্কা খাচ্ছে নৌকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আড়ালে-আবডালে আর ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা এই পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করলেও প্রকাশ্যে কথা বলছেন না। সংবাদমাধ্যমেও স্থানীয় নেতারা এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলতে নারাজ।

তবে জানতে চাইলে বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল বলেন, আড়ানীতে রেললাইনের এপার-ওপার একটা প্রভাব ফেলেছে। এপারের ভোটার ওপারের প্রার্থীকে ভোট দেননি। আবার ওপারের ভোটার এপারের প্রার্থীকে ভোট দেননি। আমরা চেষ্টা করেছি, হয়নি। বাঘা-চারঘাটে মাঝে মাঝেই নৌকার পরাজয় নিয়ে অবশ্য তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সূত্র: সোনালী সংবাদ